স্বাধীনতার সংকীর্ণ পথটি
খুব কম বুদ্ধিমান ব্যক্তিরাই বিবাদ করে যে মহাবিশ্ব প্রাকৃতিক নিয়ম দ্বারা পরিচালিত। এই নিয়মগুলি ছোট পরমাণু থেকে বৃহৎ হাজার হাজার কোটি নক্ষত্র অন্তর্ভুক্ত ছায়াপথকে নিয়ন্ত্রণ করে। যদি তা না থাকত, কোন পরিকল্পনা এবং কোন বোঝাপড়া হতে পারত না; স্বয়ং জীবনের অস্তিত্বই থাকত না। প্রাকৃতিক নিয়ম বোঝার এবং তার সাথে কার্য করার দ্বারা, মানুষ বিস্ময়কর কার্য সম্পাদন করতে পেরেছে, যেমন চাঁদে হাঁটা এবং পৃথিবীর যে কোন প্রান্ত থেকে অথবা এমনকি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে থেকে আমাদের ঘরে টিভিতে রঙীন ছবি পাঠানো।
কিন্তু নৈতিক নিয়মগুলি সম্বন্ধে কী বলা যেতে পারে? এটি ধরে রাখা কি একইভাবে উপকারী এবং ফলপ্রদ? অনেকে মনে করে যে কোন নৈতিক নিয়মাবলী নেই এবং অনুমতিদায়ক দর্শনবাদ বা ধর্ম যা তাদের নিজস্ব ইচ্ছাকে মেনে চলে সেটাই তারা বেছে নেয়।
কিন্তু, কিছু ব্যক্তি রয়েছে যারা অন্য পথ অর্থাৎ ‘জীবনে যাইবার সঙ্কীর্ণ দ্বার’ বেছে নেয় ঠিক যেমন বাইবেলে উল্লেখ রয়েছে। আমরা এটি জেনে অবাক হব না যে এই বাছাইটি শুধুমাত্র সংখ্যালঘু লোকেদের, কারণ যীশু সংকীর্ণ পথটি সম্বন্ধে বলেছিলেন: “অল্প লোকেই তাহা পায়।” (মথি ৭:১৪) কেন অল্প লোক?
কারণ সংকীর্ণ পথটি ঈশ্বরের নিয়ম এবং নীতিগুলির দ্বারা সীমাবদ্ধ। এটি কেবলমাত্র এমন ব্যক্তির হৃদয়কে স্পর্শ করবে যে আন্তরিকভাবে তার জীবনকে ঈশ্বরের মান অনুযায়ী আনতে চায়। প্রশস্ত পথ যেটি স্বাধীনতার বিভ্রম জাগায় কিন্তু বাস্তবে দাসত্বে নিয়ে যায়, এর তুলনায় সংকীর্ণ পথটি যদিও সেটিকে সীমাবদ্ধ মনে হয় কিন্তু প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এক ব্যক্তিকে এটি স্বাধীন করে। এর সীমানা “স্বাধীনতার সিদ্ধ ব্যবস্থা”-র দ্বারা নির্দিষ্ট।—যাকোব ১:২৫.
কিভাবে সংকীর্ণ পথটি স্বাধীন করে
সত্য, সব সময়ে সংকীর্ণ পথে থাকা সহজ নয়। প্রতিটি জীবিত মানুষ অসিদ্ধ এবং ভুল করার প্রতি বংশানুক্রমিক প্রবণতা আছে। তাই এক ব্যক্তি কিছুটা পরিমাণে পথভ্রষ্ট হতে পারে। তবুও, ‘দুর্গম পথে’ লেগে থাকার জন্য যে কোন প্রয়োজনীয় আত্ম-শাসন এবং রদবদল করা যথার্থ, কারণ ঈশ্বর ‘আমাদের উপকারজনক শিক্ষা দান করেন।’—যিশাইয় ৪৮:১৭; রোমীয় ৩:২৩.
উদাহরণস্বরূপ বলতে গেলে: তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য বিজ্ঞ পিতামাতারা খাদ্যের এক ‘দুর্গম পথ’ পরিকল্পনা করতে পারেন। এটি করা মানে খাওয়ার সময় কখনও কখনও কঠোর হওয়া। কিন্তু ছেলেমেয়েরা যখন বড় হয়, তারা তাদের পিতামাতাদের প্রেমপূর্ণ শাসন উপলব্ধি করে। প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে, তারা স্বাস্থ্যকর খাদ্যের প্রতি ইতিমধ্যে আস্বাদ গড়ে তুলবে। তাদের পুষ্টিকর খাদ্যের যে প্রাচুর্য রয়েছে তা সীমাবদ্ধতার অনুভূতিকে ছাপিয়ে যাবে।
আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে, ঈশ্বর যারা সংকীর্ণ পথে রয়েছে যা জীবনের দিকে নিয়ে যায় তাদের প্রতি এই একই জিনিস করেন। তিনি নম্র লোকেদের মধ্যে স্বাস্থ্যকর ইচ্ছা গড়ে তোলেন যা সুখ এবং প্রকৃত স্বাধীনতার দিকে নিয়ে যায়। এটি তিনি তাঁর বাক্য, বাইবেল যোগানোর দ্বারা করেন। এছাড়াও, আমাদের সাহায্য করার জন্য তাঁর আত্মার জন্য প্রার্থনা করতে তিনি আমন্ত্রণ জানান এবং তিনি আমাদের আদেশ দেন সহখ্রীষ্টানদের সাথে মিলিত হতে, যারা আমাদের সংকীর্ণ পথে থাকতে উৎসাহ দিতে পারে। (ইব্রীয় ১০:২৪, ২৫) হ্যাঁ, ঈশ্বর প্রেম এবং এই সর্বোৎকৃষ্ট গুণ তাঁর উদ্দেশ্য এবং তাঁর সকল প্রণালীর ভিত্তিস্বরূপ।—১ যোহন ৪:৮.
যখন প্রেম, শান্তি, মঙ্গলভাব, ইন্দ্রিয়দমন এবং ঈশ্বরের আত্মার অন্যান্য ফলগুলি জয়লাভ করে তখন সংকীর্ণ পথটিকে সীমাবদ্ধকর বলে মনে হবে না। যেমন শাস্ত্রপদটি বলে: “এই প্রকার গুণের বিরুদ্ধ ব্যবস্থা নাই।” (গালাতীয় ৫:২২, ২৩) “যেখানে প্রভুর আত্মা, সেইখানে স্বাধীনতা।” (২ করিন্থীয় ৩:১৭) এমনকি এখনও, সত্য খ্রীষ্টানেরা এই স্বাধীনতার আস্বাদ পাচ্ছে। বহু রকমের ভয় যা আজকে লোকেদের পীড়িত করছে তার থেকে এরা মুক্ত, যেমন ভবিষ্যতের ভয় এবং কুসংস্কারমূলক মৃত্যুর ভয়। সেই ভবিষ্যতের বিষয় চিন্তা করা কতই না রোমাঞ্চকর যখন “সমুদ্র যেমন জলে আচ্ছন্ন, তেমনি পৃথিবী সদাপ্রভু-বিষয়ক জ্ঞানে পরিপূর্ণ হইবে।” (যিশাইয় ১১:৯) তখন, এমনকি অপরাধের ভয়ও আর থাকবে না। তালা ও গরাদ চিরকালের জন্য আর থাকবে না। সকলে স্বাধীন এবং সুরক্ষিত মনে করবে—দিনে এবং রাতে, ঘরেতে এবং ঘরের বাইরে। সেইটিই হবে প্রকৃত স্বাধীনতা!
আমাদের ঈশ্বরের সাহায্যের নিশ্চয়তা আছে
সত্য, ঈশ্বরের মান অনুসারে চলার জন্য প্রচেষ্টার প্রয়োজন, তবুও এমনকি অসিদ্ধ মানুষের জন্য “তাঁহার আজ্ঞা সকল দুর্ব্বহ নয়।” (১ যোহন ৫:৩) ধীরে ধীরে যখন আমরা সংকীর্ণ পথে চলার জন্য রদবদল করি এবং তাতে চলার উপকারগুলি অনুভব করি, তখন আমাদের ঘৃণা বেড়ে ওঠে সেই কাজগুলি এবং চিন্তাধারাগুলির প্রতি যা প্রশস্ত পথের বৈশিষ্ট্য। (গীতসংহিতা ৯৭:১০) ঈশ্বরের নিয়মের প্রতি বাধ্য হওয়া আমাদের সকলের উত্তম দিকটিকে স্পর্শ করে। “চিত্তের দুঃখে ক্রন্দন” এবং “আত্মার ক্ষোভে হাহাকার” করার পরিবর্তে যা অনেকের মধ্যে দেখা যায়, ঈশ্বর প্রতিজ্ঞা করেন: “দেখ, আমার দাসেরা চিত্তের সুখে আনন্দরব করিবে।” হ্যাঁ, যে হৃদয় যিহোবার দ্বারা শিক্ষিত তা সুখী এবং স্বাধীন।—যিশাইয় ৬৫:১৪.
যীশু মৃত্যুবরণ করেছিলেন যাতে করে আমরা প্রকৃত স্বাধীনতা পেতে পারি। বাইবেল বলে: “ঈশ্বর জগৎকে এমন প্রেম করিলেন যে, আপনার একজাত পুত্ত্রকে দান করিলেন, যেন, যে কেহ তাঁহাতে বিশ্বাস করে, সে বিনষ্ট না হয়, কিন্তু অনন্ত জীবন পায়।” (যোহন ৩:১৬) এখন, ঈশ্বরের স্বর্গীয় রাজ্যের রাজা হিসাবে, যীশু সেই বলিদানের উপকারগুলি প্রদান করছেন। “মহাক্লেশ” এর ঠিক পরেই যখন প্রশস্ত পথটি এবং যারা তাতে চলছে তাদের শেষ আসবে, তিনি তখন ধৈর্যের সাথে বাধ্য মানবজাতিকে সংকীর্ণ পথের শেষভাগটি অর্থাৎ মানব সিদ্ধতা পর্যন্ত পরিচালনা করে নিয়ে যাবেন। (প্রকাশিত বাক্য ৭:১৪-১৭; মথি ২৪:২১, ২৯-৩১) অবশেষে আমরা মহান প্রতিজ্ঞার পরিপূর্ণতা উপলব্ধি করব: “সৃষ্টি নিজেও ক্ষয়ের দাসত্ব হইতে মুক্ত হইয়া ঈশ্বরের সন্তানগণের প্রতাপের স্বাধীনতা পাইবে।” এই ঈশ্বর-দত্ত স্বাধীনতার থেকে উৎকর্ষ আর কিছু থাকতে পারে না। এমনকি মৃত্যু আর থাকবে না।—রোমীয় ৮:২১; প্রকাশিত বাক্য ২১:৩, ৪.
সংকীর্ণ পথটি কোন্ দিকে নিয়ে যায় তা স্পষ্টভাবে দেখা ও বোঝার দ্বারা, একজন ব্যক্তি এই পথটি আরও ভালভাবে বেছে নিতে ও সেই পথে অবিরত চলতে সমর্থ হয়। অল্প বয়স্কদের বিশেষ করে সাহায্য করা হচ্ছে যাতে করে তারা অদূরদর্শী না হয় এবং ঈশ্বরের মান যা তারা সীমাবদ্ধ বলে মনে করে সেই বিষয়ে যেন বিরক্তি প্রকাশ না করে। তারা এই বিষয়ে শিক্ষিত হয় যে এগুলি হল ঈশ্বরের প্রেমের প্রমাণ এবং প্রশস্ত পথের মন্দ জিনিসগুলির বিরুদ্ধে এক সুরক্ষাস্বরূপ। (ইব্রীয় ১২:৫, ৬) অবশ্যই, একজনকে ধৈর্যশীল হতে হবে, এই মনে রেখে যে ঈশ্বরীয় গুণাবলি এবং ইচ্ছা গড়ে তুলতে সময় লাগে, ঠিক যেমন ফল গাছে ভাল ফল হতে সময় লাগে। কিন্তু গাছে ফল ধরবে যদি তা রক্ষণাবেক্ষণ করা এবং জল দেওয়া হয়।
তাই, ঈশ্বরের বাক্য পড়ুন, অন্য খ্রীষ্টানদের সাথে মেলামেশা করুন এবং পবিত্র আত্মার জন্য “অবিরত প্রার্থনা” করুন। (১ থিষলনীকীয় ৫:১৭) ‘আপনার পথ সকল সরল’ করতে সাহায্যের জন্য ঈশ্বরের উপর আস্থা রাখুন। (হিতোপদেশ ৩:৫, ৬) কিন্তু এইসব করা কি বাস্তবধর্মী? এটি কি সত্যই কার্যকারী? হ্যাঁ, এটি টম এবং সেই সঙ্গে মারীর ক্ষেত্রে কাজ করেছিল, যাদের বিষয়ে আগের প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে।
তারা প্রশস্ত পথে চলা বন্ধ করে দিয়েছে
টম লেখেন: “১৯৭০ দশকের মাঝামাঝি, যিহোবার সাক্ষীদের সাথে আমাদের যোগাযোগ হয়, যখন তাদের মধ্যে একজন আমাদের গৃহেতে আসেন। আলোচনা বাইবেল অধ্যয়নে পরিচালিত করে। ধীরে ধীরে আমি আমার জীবন শুদ্ধ করতে শুরু করি। ১৯৮২ সালে আমি বাপ্তিস্ম গ্রহণ করি এবং এখন আমি স্থানীয় মণ্ডলীতে সেবা করছি। আমাদের ছেলেও বাপ্তিস্মিত। যখন সেইদিনগুলিতে আমি সত্যে ছিলাম না তখন আমার স্ত্রী সহনশীল হওয়ার জন্য আমি আমার স্ত্রীকে ধন্যবাদ দিচ্ছি। আর সর্বোপরি আমি যিহোবা এবং তাঁর পুত্র, খ্রীষ্ট যীশুকে ধন্যবাদ দিই, সবকিছু আমাদের দেওয়ার জন্য এবং ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আমাদের যে আশা আছে তার জন্য।”
আর মারী সম্বন্ধে কী বলা যেতে পারে? হ্যাঁ, সে মনে করেছিল ঈশ্বর তাকে কখনও ক্ষমা করবেন না, কিন্তু তার ছেলেমেয়েদের জন্য সে ঈশ্বর সম্বন্ধে জানতে চেয়েছিল। যখন সে জানতে পারে যে, একজন যিহোবা সাক্ষী তার প্রতিবেশীকে বাইবেল শিখাচ্ছেন, সেও সাহায্য চেয়েছিল। কিন্তু, তার মধ্যে যে বদ্ধমূল বদ অভ্যাসগুলি ছিল তা তার উন্নতিকে ব্যাহত করে। অধ্যয়ন এক এক সময় অগ্রসর হয় এক এক সময় পিছিয়ে যায়। তার ছোট সাত বছরের মেয়ে তাকে উৎসাহিত করে চলে। সে বলত, “মা, হাল ছেড়ে দিও না। তুমি করতে পারবে!” তারপর মারী আরও কঠোরভাবে চেষ্টা করত।
যখন তার স্বামী যার সাথে তার আইনত বিবাহ হয়নি, যে ড্রাগে আসক্ত ছিল ঘরে ফিরে আসে তখন সেও অধ্যয়নে যোগ দেয়। পরিশেষে দুইজনেই তাদের বদ অভ্যাসের উপর জয়লাভ করে। তারপর, আইনত তাদের বিবাহকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর এবং বাপ্তিস্ম নেওয়ার পর, তারা প্রচুর সুখ উপভোগ করে এবং প্রথমবার প্রকৃত পরিবার হিসাবে নিজেদের অনুভব করে। দুঃখের বিষয় এই যে, এইডস মারীর জীবনকে নিয়ে নেয়, কিন্তু সে বাইবেলের প্রতিজ্ঞা যে পরমদেশ পৃথিবীতে পুনরুত্থান এবং জীবন যেখানে ক্ষতিকর প্রশস্ত পথের নামমাত্র থাকবে না তার উপর তার হৃদয় কেন্দ্রীভূত করে মারা যায়।
হ্যাঁ, এই প্রশস্ত এবং চওড়া পথ যা ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায় তা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। খ্রীষ্ট যীশু বলেছিলেন: “আর ইহাই অনন্ত জীবন যে, তাহারা তোমাকে, একমাত্র সত্যময় ঈশ্বরকে, এবং তুমি যাঁহাকে পাঠাইয়াছ, তাঁহাকে, যীশু খ্রীষ্টকে, জানিতে পায়।” (যোহন ১৭:৩) সংকীর্ণ পথটি যা জীবনের দিকে নিয়ে যায় তাতে চলতে অধ্যবসায় হোন না কেন? ঈশ্বরের বাক্য যা শিখছেন হৃদয়ে গ্রহণ করে এবং প্রয়োগ করে আপনি হয়ত ব্যক্তিগতভাবে বাইবেলের হৃদয়স্পর্শী প্রতিজ্ঞা উপলব্ধি করবেন: “তোমরা সেই সত্য জানিবে, এবং সেই সত্য তোমাদিগকে স্বাধীন করিবে।”—যোহন ৮:৩২.