তারা তাদের বিশ্বাসের কারণে ঘৃণিত হয়েছিলেন
“আমার নাম প্রযুক্ত তোমরা সকলের ঘৃণিত হইবে।”—মথি ১০:২২.
১, ২. আপনি কি যিহোবার সাক্ষীদের কয়েকটি বাস্তব অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে বলতে পারেন যা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে চলার কারণে হয়েছিল?
ক্রিট দ্বীপের একজন সৎ দোকানদারকে অনেক বার গ্রেপ্তার করা হয় এবং বেশ কয়েক বার গ্রিক আদালতে হাজির করা হয়। স্ত্রী ও তার পাঁচ সন্তানের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায়, তিনি সব মিলিয়ে ছয় বছরেরও বেশি সময় জেলে ছিলেন। জাপানে, ১৭ বছর বয়সের একটি ছাত্রকে বিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়া হয়, যদিও সে তার ক্লাসের ৪২ জনের মধ্যে সবচেয়ে ভাল ছাত্র ছিল আর তার আচার-আচরণও ভদ্র ছিল। ফ্রান্সে, কিছু ব্যক্তিকে কোন পূর্ব বিজ্ঞপ্তি না দিয়েই চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়, যদিও সবাই জানতেন যে তারা পরিশ্রমী ও সৎ কর্মী। এই বাস্তব অভিজ্ঞতাগুলির মধ্যে সাধারণ যোগসূত্রটি কী?
২ এরা সবাই যিহোবার সাক্ষী। তাদের “অপরাধ”? মূলত, তারা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে চলেন। যীশু খ্রীষ্টের শিক্ষার প্রতি বাধ্য হয়ে সেই দোকানদার তার বিশ্বাস সম্বন্ধে অন্যদের কাছে বলেছিলেন। (মথি ২৮:১৯, ২০) তাকে একটি পুরনো গ্রিক আইনবলে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল, যে আইন ধর্মান্তরিত করাকে এক অপরাধমূলক কাজ হিসাবে বলে। ছাত্রটিকে বের করে দেওয়া হয়েছিল কারণ তার বাইবেল শিক্ষিত বিবেক তাকে বাধ্যতামূলক কেন্ডো (জাপানি তলোয়ার খেলা) অনুশীলনে অংশ নিতে বাধা দিয়েছিল। (যিশাইয় ২:৪) আর ফ্রান্সে যাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয় তাদেরকে জানানো হয়েছিল, তাদের বহিষ্কার করার একমাত্র কারণ হল তারা যিহোবার সাক্ষী।
৩. কেন বেশিরভাগ যিহোবার সাক্ষী অন্য মানুষদের হাতে তুলনামূলকভাবে কম লাঞ্ছিত হন?
৩ সম্প্রতি কিছু দেশে যিহোবার সাক্ষীদের এইধরনের নির্মম পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু, বেশিরভাগ যিহোবার সাক্ষী অন্য মানুষদের হাতে তুলনামূলকভাবে খুব কমই লাঞ্ছিত হন। যিহোবার লোকেরা সারা পৃথিবীতে তাদের উত্তম আচরণের জন্য পরিচিত আর এই সুনামের জন্যই কেউ তাদের ক্ষতি করার কোন বৈধ কারণ খুঁজে পান না। (১ পিতর ২:১১, ১২) তারা কারও বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেন না কিংবা কারও ক্ষতিও করেন না। (১ পিতর ৪:১৫) বরং, তারা বাইবেলের পরামর্শ অনুযায়ী প্রথমে ঈশ্বরের এবং পরে জাগতিক সরকারের বশীভূত হয়ে জীবনযাপন করার চেষ্টা করেন। তারা সমস্ত বৈধ কর পরিশোধ করেন এবং “মনুষ্যমাত্রের সহিত শান্তিতে” থাকার চেষ্টা করে থাকেন। (রোমীয় ১২:১৮; ১৩:৬, ৭; ১ পিতর ২:১৩-১৭) তারা তাদের বাইবেল শিক্ষার কার্যক্রমে, আইন, পারিবারিক মূল্যবোধ এবং নৈতিকতার প্রতি শ্রদ্ধা গড়ে তুলতে উৎসাহিত করেন। আইনমান্যকারী নাগরিক হওয়ায়, বিভিন্ন সরকার তাদের প্রশংসা করেছে। (রোমীয় ১৩:৩) তবুও, প্রথম অনুচ্ছেদে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে যে তারা মাঝে মাঝে বিরোধিতার শিকার হয়ে থাকেন এমনকি কিছু দেশে তাদের উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়। এইসব দেখে কি আমাদের আশ্চর্য হওয়া উচিত?
শিষ্য হওয়ার “মূল্য”
৪. যীশুর বাক্য অনুযায়ী, যারা তাঁর শিষ্য হবেন তারা কী আশা করতে পারেন?
৪ যীশু খ্রীষ্ট তাঁর শিষ্য হওয়ার সঙ্গে কী কী জড়িত সেই বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ রাখেননি। তিনি তাঁর অনুগামীদের বলেছিলেন: “দাস আপন প্রভু হইতে বড় নয়; লোকে যখন আমাকে তাড়না করিয়াছে, তখন তোমাদিগকেও তাড়না করিবে।” যীশু “অকারণে” ঘৃণিত হয়েছিলেন। (যোহন ১৫:১৮-২০, ২৫; গীতসংহিতা ৬৯:৪; লূক ২৩:২২) তাঁর শিষ্যরাও একই বিষয় অর্থাৎ অন্যায় বিরোধিতা আশা করতে পারেন। একাধিকবার তিনি তাদের সতর্ক করেছিলেন: “তোমরা . . . ঘৃণিত হইবে।”—মথি ১০:২২; ২৪:৯.
৫, ৬. (ক) কোন্ কারণে যীশু তাঁর সম্ভাব্য অনুগামীদের “মূল্য হিসাব” করার পরামর্শ দিয়েছিলেন? (খ) তাহলে কেন আমরা বিরোধিতার সম্মুখীন হলে আমাদের দিশেহারা হয়ে পড়া উচিত নয়?
৫ ফলে, যীশু তাঁর সম্ভাব্য অনুগামীদের শিষ্য হওয়ার “মূল্য হিসাব” করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। (লূক ১৪:২৮, রিভাইস্ড স্ট্যান্ডার্ড ভারসন) কেন? তাদের তাঁর শিষ্য হওয়া উচিত কি না সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য নয় কিন্তু তারা যাতে এর সঙ্গে যে দায়িত্বগুলি আসে তা পরিপূর্ণ করতে দৃঢ়সংকল্প হতে পারেন। শিষ্য হওয়ার সুযোগের সঙ্গে আসা যে কোন পরীক্ষা ও কষ্ট সহ্য করার জন্য আমাদের তৈরি হতে হবে। (লূক ১৪:২৭) খ্রীষ্টের শিষ্য হয়ে যিহোবার সেবা করার জন্য কেউ আমাদের জোর করেন না। এই সিদ্ধান্ত আমরা নিজের ইচ্ছায় নিই আর সবকিছু জেনেশুনেই নিই। আমরা আগে থেকেই জানি যে ঈশ্বরের সঙ্গে এক উৎসর্গীকৃত সম্পর্ক গড়ে তোলার কারণে আমরা আশীর্বাদ পাব আর সেইসঙ্গে ‘ঘৃণিতও’ হব। তাই বিরোধিতার মুখোমুখি হলে আমরা দিশেহারা হয়ে পড়ি না। আমরা “মূল্য হিসাব” করেছি আর তা মেটানোর জন্য সম্পূর্ণ তৈরিও আছি।—১ পিতর ৪:১২-১৪.
৬ কেন কিছু লোকেরা, এমনকি কিছু কিছু সরকারি কর্তৃপক্ষ, সত্য খ্রীষ্টানদের বিরোধিতা করেন? উত্তর পাওয়ার জন্য আমাদের প্রথম শতাব্দীর দুটি ধর্মীয় দলের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। দুটি দলই ঘৃণিত হয়েছিল—কিন্তু একেবারেই আলাদা আলাদা কারণে।
ঘৃণ্য এবং ঘৃণিত
৭, ৮. কোন্ শিক্ষা পরজাতীয়দের প্রতি ঘৃণা উৎপন্ন করেছিল আর এর ফলে যিহূদীদের মধ্যে কোন্ মনোভাব গড়ে উঠেছিল?
৭ সাধারণ কালের প্রথম শতাব্দীতে ইস্রায়েল রোমীয় শাসনের অধীনে ছিল এবং যিহূদীবাদ অর্থাৎ যিহূদী ধর্মীয় ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ফরীশী ও অধ্যাপকদের মতো অত্যাচারী নেতাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। (মথি ২৩:২-৪) এই গোঁড়া নেতারা পরজাতিদের থেকে পৃথক থাকার বিষয়ে মোশির ব্যবস্থায় যে আদেশগুলি দেওয়া ছিল, সেগুলিকে বিকৃত করে এমন নিয়ম বানান যা ন-যিহূদীদেরকে অবজ্ঞা করতে শেখাতো। এর থেকে তারা এমন এক ধর্ম গড়ে তোলেন যা পরজাতীয়দের ঘৃণা করত ফলে পরজাতীয়রাও তাদের ঘৃণা করতে শুরু করেছিল।
৮ পরজাতীয়দের বিরুদ্ধে ঘৃণার মনোভাব ছড়িয়ে দেওয়া যিহূদী নেতাদের জন্য কঠিন কিছু ছিল না কারণ সেই সময় যিহূদীরা পরজাতীয়দেরকে নিম্ন শ্রেণীর বলে গণ্য করত। ধর্মীয় নেতারা শিক্ষা দিতেন যে একজন যিহূদী নারীর কখনই পরজাতীয়দের সঙ্গে একা থাকা উচিত নয় কেননা তাদের “চরিত্রহীন বলে ভাবা হতো।” একজন যিহূদী পুরুষ “তাদের সঙ্গে একা থাকতে পারবে না কারণ তাদের হত্যাকারী হিসাবে ভাবা হতো।” পরজাতীয় ব্যক্তির দোহা দুধ ব্যবহার করা যেত না, যদি না একজন যিহূদী সেখানে উপস্থিত থেকে দোহন করা দেখত। যিহূদীরা তাদের নেতাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এক রক্ষণশীল এবং কঠোর অবজ্ঞাপূর্ণ মানসিকতা গড়ে তুলেছিল।—যোহন ৪:৯ পদের সঙ্গে তুলনা করুন।
৯. ন-যিহূদীদের সম্বন্ধে যিহূদী নেতারা যে শিক্ষা দিয়েছিলেন তার ফলাফল কী হয়েছিল?
৯ ন-যিহূদীদের সম্বন্ধে এইধরনের শিক্ষা, যিহূদী ও পরজাতীয়দের মধ্যে ভাল সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি। পরজাতীয়রা মনে করত যে যিহূদীরা সমস্ত মানবজাতিকেই ঘৃণা করে। রোমীয় ইতিহাসবেত্তা ট্যাসিটাস (প্রায় সা.কা. ৫৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন) যিহূদীদের সম্বন্ধে বলেছিলেন যে “তারা নিজেদের ছাড়া অন্য সমস্ত মানুষকে শত্রুর মতো ঘৃণা করত।” ট্যাসিটাস আরও বলেছিলেন, যে পরজাতীয়রা যিহূদী ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তাদেরকে শেখানো হতো, তারা যেন নিজের দেশের অধিকার ত্যাগ করেন এবং তাদের পরিবার ও বন্ধুবান্ধদের নিচু চোখে দেখেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, রোমীয়রা যিহূদীদের প্রতি সহনশীল ছিল কারণ সংখ্যায় তারা বেশি হওয়ায় তাদের বশে আনা সহজ ছিল না। কিন্তু সা.কা. ৬৬ সালের যিহূদী বিদ্রোহ রোমীয়দের মধ্যে তীব্র প্রতিহিংসা জাগিয়ে তুলেছিল ফলে তারা সা.কা. ৭০ সালে যিরূশালেম ধ্বংস করেছিল।
১০, ১১. (ক) মোশির ব্যবস্থায় বিদেশীদের প্রতি কীধরনের আচরণ করার বিষয়ে উল্লেখ ছিল? (খ) যিহূদী ধর্মের প্রতি যা হয়েছিল তার থেকে আমরা কী শিখি?
১০ মোশির ব্যবস্থায় উল্লেখিত উপাসনা পদ্ধতি থেকে বিদেশীদের প্রতি যিহূদীদের এই দৃষ্টিভঙ্গি কিভাবে আলাদা ছিল? পরজাতিদের থেকে পৃথক থাকার বিষয়টি ব্যবস্থায় বলা হয়েছিল ঠিকই কিন্তু তা ইস্রায়েলীয়দের, বিশেষ করে তাদের বিশুদ্ধ উপাসনাকে রক্ষা করার জন্য ছিল। (যিহোশূয়ের পুস্তক ২৩:৬-৮) তারপরও, ব্যবস্থায় এই আদেশ দেওয়া হয়েছিল যে বিদেশীদের সঙ্গে ন্যায্য ও পক্ষপাতহীন আচরণ করতে হবে এবং তাদের সাদরে গ্রহণ করতে হবে—যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা চরমভাবে ইস্রায়েলের ব্যবস্থা লঙ্ঘন করে। (লেবীয় পুস্তক ২৪:২২) ব্যবস্থায় বিদেশীদের প্রতি দয়া দেখানোর যে যুক্তিসংগত নীতিগুলি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা ছিল সেগুলি বাদ দিয়ে, যীশুর দিনের যিহূদী ধর্মীয় নেতারা এমন এক উপাসনা পদ্ধতি গড়ে তুলেছিলেন যা বিদেশীদের ঘৃণা করত, ফলে তারাও এটিকে ঘৃণা করেছিল। পরিণতিস্বরূপ, প্রথম শতাব্দীর যিহূদী জাতি যিহোবার অনুগ্রহ হারিয়েছিল।—মথি ২৩:৩৮.
১১ এর থেকে আমাদের কি কিছু শেখার আছে? হ্যাঁ। যিহোবা চান না যে তাঁর উপাসকেরা নিজেদের অন্যদের চেয়ে ধার্মিক ও শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে আর অন্য ধর্মের লোকেদের ছোট করে দেখে। আর এই আচরণে তিনি খুশিও হন না। প্রথম শতাব্দীর বিশ্বস্ত খ্রীষ্টানদের কথা চিন্তা করুন। তারা ন-খ্রীষ্টানদের ঘৃণা করতেন না কিংবা রোমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহও করেননি। তাসত্ত্বেও তারা “ঘৃণিত” হয়েছিলেন। কেন? কাদের কাছে?
প্রাথমিক খ্রীষ্টানেরা—কাদের কাছে ঘৃণিত হয়েছিলেন?
১২. শাস্ত্র থেকে এটি কিভাবে স্পষ্ট হয় যে যীশু চেয়েছিলেন যেন তাঁর অনুগামীরা ন-খ্রীষ্টানদের প্রতি এক ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি রাখে?
১২ যীশুর শিক্ষা থেকে এই বিষয়টি স্পষ্ট হয় যে তিনি চেয়েছিলেন তাঁর শিষ্যরা যেন ন-খ্রীষ্টানদের প্রতি এক ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি রাখেন। একবার তিনি বলেছিলেন, তাঁর শিষ্যরা জগৎ থেকে পৃথক হবেন—অর্থাৎ যে মনোভাব ও আচারব্যবহারগুলি যিহোবার ধার্মিক পথের বিপরীত সেগুলি থেকে তাদের সম্পূর্ণভাবে দূরে থাকতে হবে। তারা যুদ্ধ ও রাজনীতিতে নিরপেক্ষ থাকবেন। (যোহন ১৭:১৪, ১৬) আর ন-খ্রীষ্টানদের ঘৃণা করার কথা প্রচার করা তো দূরের কথা যীশু তাঁর শিষ্যদের বলেছিলেন তোমরা “আপন আপন শত্রুদিগকে প্রেম করিও।” (মথি ৫:৪৪) প্রেরিত পৌল খ্রীষ্টানদের পরামর্শ দিয়েছিলেন: “তোমার শত্রু যদি ক্ষুধিত হয়, তাহাকে ভোজন করাও; যদি সে পিপাসিত হয়, তাহাকে পান করাও।” (রোমীয় ১২:২০) এছাড়াও তিনি খ্রীষ্টানদেরকে “সকলের প্রতি . . . সৎকর্ম্ম” করতে বলেছিলেন।—গালাতীয় ৬:১০.
১৩. কেন যিহূদী ধর্মীয় নেতারা খ্রীষ্টের শিষ্যদের প্রতি কঠোর বিরোধিতা করেছিলেন?
১৩ তবুও, খ্রীষ্টের শিষ্যদের তিন শ্রেণীর লোকেদের কাছ থেকে “ঘৃণিত” হতে হয়েছিল। প্রথমত যিহূদী ধর্মীয় নেতাদের কাছ থেকে। আশ্চর্যের বিষয় নয় যে খুব শীঘ্রই তাদের মনোযোগ খ্রীষ্টানদের প্রতি গিয়েছিল! নৈতিক আচরণ ও আনুগত্যতার বিষয়ে খ্রীষ্টানদের নীতি খুবই উঁচু ছিল আর তারা খুবই উদ্যোগের সঙ্গে আশার বার্তা প্রচার করতেন। হাজার হাজার ব্যক্তি যিহূদী ধর্ম ত্যাগ করে খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। (প্রেরিত ২:৪১; ৪:৪; ৬:৭) যিহূদী ধর্মীয় নেতাদের কাছে, যীশুর যিহূদী শিষ্যরা ধর্মভ্রষ্ট ছাড়া আর কিছুই ছিলেন না! (প্রেরিত ১৩:৪৫ পদের সঙ্গে তুলনা করুন।) এই ক্রুদ্ধ নেতারা মনে করেছিলেন যে খ্রীষ্ট ধর্ম তাদের পরম্পরাগত রীতিগুলিকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। এমনকি এটি পরজাতীয়দের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকেও অগ্রাহ্য করেছে! সা.কা. ৩৬ সাল থেকে পরজাতীয়রা খ্রীষ্টান হতে পারতেন এবং যিহূদী খ্রীষ্টানদের মতো একই বিশ্বাসে বিশ্বাসী হতে ও খ্রীষ্টীয় সুযোগগুলি উপভোগ করতে পারতেন।—প্রেরিত ১০:৩৪, ৩৫.
১৪, ১৫. (ক) কেন খ্রীষ্টানেরা পৌত্তলিক উপাসকদের কাছে ঘৃণিত ছিলেন? একটি উদাহরণ দিন। (খ) প্রাথমিক খ্রীষ্টানেরা তৃতীয় কোন্ দলের কাছে “ঘৃণিত” হয়েছিলেন?
১৪ দ্বিতীয়ত, খ্রীষ্টানরা পৌত্তলিক উপাসকদের কাছে ঘৃণিত ছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, প্রাচীন ইফিষে রুপো দিয়ে দীয়ানা দেবীর মূর্তি তৈরি করা একটি লাভজনক ব্যবসা ছিল। কিন্তু পৌল যখন সেখানে প্রচার করেছিলেন, তখন বেশ কিছু সংখ্যক ইফিষীয় লোক সাড়া দিয়েছিলেন ও দীয়ানার পূজা করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তাদের ব্যবসায়ে ক্ষতির সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায়, রৌপ্যকারকেরা বিক্ষোভ করেছিলেন। (প্রেরিত ১৯:২৪-৪১) বিথিনিয়ায় (এখন উত্তরপশ্চিম তুর্কি) খ্রীষ্টধর্ম প্রসারিত হওয়ার পর কিছুটা একইরকম ঘটনা ঘটেছিল। খ্রীষ্টীয় গ্রিক শাস্ত্র লেখা শেষ হওয়ার অল্প সময় পরে, বিথিনিয়ার শাসক কনিষ্ঠ প্লিনি অভিযোগ করেছিলেন যে পৌত্তলিক মন্দিরগুলি জনশূন্য হয়ে পড়ছে ফলে বলির পশুদের জন্য খাদ্য বিক্রির হার একেবারে কমে গিয়েছে। খ্রীষ্টানদের দোষ দেওয়া হয়েছিল—এবং তাদের উপর নির্যাতন করা হয়েছিল—কারণ তাদের উপাসনায়, পশু বলি দেওয়া হতো না আর মূর্তিরও প্রয়োজন ছিল না। (ইব্রীয় ১০:১-৯; ১ যোহন ৫:২১) স্পষ্টতই, খ্রীষ্টধর্মের প্রসার পৌত্তলিক উপাসনা থেকে যে লাভ হত তার ক্ষতি করেছিল, ফলে যে লোকেদের ব্যবসা ও উপার্জন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তারা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।
১৫ তৃতীয়ত, খ্রীষ্টানরা জাতীয়তাবাদী রোমীয়দের কাছে “ঘৃণিত” হয়েছিলেন। প্রথমে, রোমীয়রা খ্রীষ্টানদেরকে একটি ছোট এবং সম্ভবত গোড়াঁ ধর্মীয় দল হিসাবে জানত। কিন্তু পরে, কেবল খ্রীষ্টান বলে দাবি করাটা মৃত্যুযোগ্য অপরাধে পরিণত হয়। কেন খ্রীষ্টীয় জীবনযাপনকারী সৎ নাগরিকদের নির্যাতন এবং মৃত্যদণ্ডের যোগ্য হিসাবে দেখা হতো?
প্রাথমিক খ্রীষ্টানেরা—কেন রোমীয় সাম্রাজ্যে ঘৃণিত হয়েছিলেন?
১৬. কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে খ্রীষ্টানেরা জগৎ থেকে পৃথক ছিলেন এবং কেন তা রোমীয় সাম্রাজ্যে তাদেরকে অপ্রিয় করে তুলেছিল?
১৬ খ্রীষ্টানেরা মূলত তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে চলার কারণেই রোমীয় সাম্রাজ্যে ঘৃণিত হয়েছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, তারা জগতের যুদ্ধ ও রাজনীতি থেকে পৃথক ছিলেন। (যোহন ১৫:১৯) তাই তারা কোন রাজনৈতিক কাজে অংশ নেননি ও সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেননি। ফলে, ইতিহাসবেত্তা অগাস্টাস নিয়ানডার যেমন বলেন, তাদেরকে “জগতের কাছে মৃত এবং জীবনের কোন কাজেই আসে না এমন লোক হিসাবে মনে করা হতো।” এছাড়াও জগতের অংশ না হওয়ার অর্থ ছিল দুনীর্তিপরায়ণ রোমীয় সাম্রাজ্যের পাপপূর্ণ জীবনযাত্রা এড়িয়ে চলা। ইতিহাসবেত্তা উইল ডুরান্ট বলেন, “খ্রীষ্টানদের ছোট ছোট দলগুলি তাদের ধার্মিকতা এবং শিষ্টাচারের কারণে যেন সুখাভিলাষী পৌত্তলিক সমাজের চোখে কাঁটার মত বিঁধছিল।” (১ পিতর ৪:৩, ৪) খ্রীষ্টানদের উপর নির্যাতন এবং তাদের হত্যা করে, রোমীয়রা হয়তো ঝামেলা সৃষ্টিকারী নীতিবোধের কন্ঠকে চিরদিনের মতো স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল।
১৭. কী দেখায় যে প্রথম শতাব্দীর খ্রীষ্টানদের প্রচার কাজ ফলপ্রসূ হয়েছিল?
১৭ প্রথম শতাব্দীর খ্রীষ্টানেরা এত বেশি উদ্যোগের সঙ্গে ঈশ্বরের রাজ্যের সুসমাচার প্রচার করেছিলেন যা কোন সময়েই কমে যায়নি। (মথি ২৪:১৪) প্রায় সা.কা. ৬০ সালের মধ্যে, পৌল বলতে পেরেছিলেন যে সুসমাচার “আকাশমণ্ডলের অধঃস্থিত সমস্ত সৃষ্টির কাছে প্রচারিত হইয়াছে।” (কলসীয় ১:২৩) প্রথম শতাব্দীর শেষ হওয়া পর্যন্ত, যীশুর অনুগামীরা রোমীয় সাম্রাজ্যের সর্বত্র—এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকায়—শিষ্য তৈরি করেছিলেন! এমনকি “কৈসরের বাটীর” কিছু সদস্য খ্রীষ্টান হয়েছিলেন।a (ফিলিপীয় ৪:২২) এই উদ্যোগী প্রচার অসন্তোষের সৃষ্টি করেছিল। নিয়ানডার বলেন: “খ্রীষ্টধর্ম সমস্ত শ্রেণীর লোকেদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল আর রাষ্ট্রীয় ধর্মকে শেষ করে দেওয়া ও সেই সঙ্গে নাগরিক জীবনের রীতিনীতিকে উৎখাত করার হুমকি দেখা দিয়েছিল।”
১৮. একমাত্র যিহোবার আরাধনা করা কিভাবে রোমীয় সরকারের সঙ্গে খ্রীষ্টানদের মতভেদ সৃষ্টি করেছিল?
১৮ যীশুর অনুগামীরা একমাত্র যিহোবার আরাধনা করতেন। (মথি ৪:৮-১০) সম্ভবত তাদের উপাসনার এই বৈশিষ্ট্যটিই রোমীয়দের সঙ্গে তাদের মতভেদ সৃষ্টি করেছিল। রোমীয়রা অন্য ধর্মগুলিকে মেনে নিতেন যদি কেবল তাদের অনুগামীরা সম্রাটের উপাসনায় অংশ নিত। কিন্তু প্রাথমিক খ্রীষ্টানেরা এইধরনের উপাসনায় কোনভাবেই অংশ নেননি। তারা মনে করতেন যে রোমীয় রাষ্ট্রের চেয়ে আরও উচ্চ কর্তৃপক্ষ, যিহোবা ঈশ্বরের কাছে তাদের নিকাশ দিতে হবে। (প্রেরিত ৫:২৯) ফলে, খ্রীষ্টানেরা অন্যান্য সমস্ত ক্ষেত্রে যত ভাল নাগরিকই থাকুন না কেন, তাদের রাষ্ট্রের শত্রু হিসাবে দেখা হতো।
১৯, ২০. (ক) বিশ্বস্ত খ্রীষ্টানদের সম্বন্ধে যে বিদ্বেষপূর্ণ অপবাদ রটানো হয়েছিল তার জন্য কারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দায়ী ছিলেন? (খ) খ্রীষ্টানদের বিরুদ্ধে কোন্ মিথ্যা অভিযোগগুলি করা হয়েছিল?
১৯ রোমীয় সাম্রাজ্যে বিশ্বস্ত খ্রীষ্টানেরা কেন “ঘৃণিত” হয়েছিলেন তার আরও একটি কারণ ছিল আর তা হল: তাদের সম্বন্ধে রটানো বিদ্বেষপূর্ণ অপবাদ সহজেই সকলে বিশ্বাস করত আর এই অপবাদের জন্য যিহূদী ধর্মীয় নেতারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দায়ী ছিলেন। (প্রেরিত ১৭:৫-৮) প্রায় সা.কা ৬০ কিংবা ৬১ সালে, পৌল যখন রোমে সম্রাট নিরোর বিচারের অপেক্ষা করছিলেন, তখন যিহূদী নেতারা খ্রীষ্টানদের সম্বন্ধে বলেছিলেন: “এই দলের বিষয়ে আমরা জানি যে, সর্ব্বত্র লোকে ইহার বিরুদ্ধে কথা বলিয়া থাকে।” (প্রেরিত ২৮:২২) নিরোও নিশ্চয়ই তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপবাদমূলক কাহিনী শুনেছিলেন। সা.কা. ৬৪ সালে, যখন রোমের ধ্বংসকারী অগ্নিকাণ্ডের জন্য নিরোকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, তখন বলা হয় যে তিনি ইতিমধ্যেই অপবাদবহনকারী খ্রীষ্টানদের উপর তার দুষ্কর্মের দায় চাপিয়েছিলেন। এর ফলে খ্রীষ্টানদেরকে সম্পূর্ণরূপে উচ্ছেদ করার দৃঢ়সংকল্প নিয়ে হিংস্র নির্যাতন চালানো হয়েছিল।
২০ খ্রীষ্টানদের বিরুদ্ধে আনা মিথ্যা অভিযোগগুলির মধ্যে প্রায়ই তাদের সম্বন্ধে পুরোপুরি মিথ্যা বলা হতো আর তাদের বিশ্বাসকে বিকৃত করে তুলে ধরা হতো। যেহেতু তারা সম্রাটের উপাসনা না করে এক ঈশ্বরের উপাসনা করতেন, তাই তাদের নাস্তিক বলা হতো। পরিবারের কিছু ন-খ্রীষ্টান সদস্য তাদের খ্রীষ্টান আত্মীয়দের বিরোধিতা করতেন বলে, খ্রীষ্টানদেরকে পরিবারে ভাঙন নিয়ে আসার দোষ দেওয়া হয়েছিল। (মথি ১০:২১) তাদের নরখাদক বলা হয়েছিল। কিছু প্রামাণিক গ্রন্থ অনুযায়ী, প্রভুর সান্ধ্য ভোজে যীশু যে কথাগুলি বলেছিলেন সেগুলিকে বিকৃত করে তাদের প্রতি এই অভিযোগ করা হয়।—মথি ২৬:২৬-২৮.
২১. কোন্ দুটি কারণের জন্য খ্রীষ্টানেরা “ঘৃণিত” হয়েছিলেন?
২১ অতএব, বিশ্বস্ত খ্রীষ্টানেরা দুটি মূল কারণে রোমীয়দের কাছে “ঘৃণিত” হয়েছিলেন: (১) তাদের বাইবেলভিত্তিক বিশ্বাস ও কাজ এবং (২) তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ। কারণ যাই হোক না কেন, সমস্ত বিরোধীদের একটি মাত্র লক্ষ্য ছিল—খ্রীষ্টধর্মকে নির্মূল করা। অবশ্য, খ্রীষ্টানদের নির্যাতন করার পিছনে মূল প্ররোচকেরা ছিল অতিমানবিক বিরোধী, অদৃশ্য দুষ্ট আত্মারা।—ইফিষীয় ৬:১২.
২২. (ক) কোন্ উদাহরণ দেখায় যে যিহোবার সাক্ষীরা ‘সকলের প্রতি সৎকর্ম্ম করার’ জন্য প্রাণপণ করেন? (১১ পৃষ্ঠার বাক্সটি দেখুন।) (খ) পরের প্রবন্ধটিতে কী আলোচনা করা হবে?
২২ প্রাথমিক খ্রীষ্টানদের মতো, আধুনিক দিনের যিহোবার সাক্ষীরাও বিভিন্ন দেশে “ঘৃণিত” হয়েছেন। তথাপি, তারা অন্য ধর্মের লোকেদের ঘৃণা করেন না কিংবা তারা কখনও সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহও করেননি। পরিবর্তে, সমগ্র পৃথিবীতে তারা অকৃত্রিম প্রেম দেখানোর জন্য পরিচিত আর এই প্রেমকে সামাজিক, জাতিগত এবং উপজাতিগত কোন ভেদাভেদই বাধা দিতে পারে না। কিন্তু তারপরও কেন তারা নির্যাতিত হয়েছেন? আর বিরোধিতার সময় তারা কি করেন? আমাদের পরের প্রবন্ধটি এই প্রশ্নগুলির উত্তর দেবে।
[পাদটীকাগুলো]
a “কৈসরের বাটীর লোক” অভিব্যক্তিটি যে তখনকার শাসক নিরোর পরিবারের নিকট সদস্যদেরকেই ইঙ্গিত করে তা নয়। বরং, এটি বাড়ির চাকর ও নিম্ন শ্রেণীর কর্মকর্তাদের উল্লেখ করে, যারা হয়তো রাজ পরিবার এবং কর্মচারীদের জন্য রান্নাবান্না ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা জাতীয় গৃহস্থালির কাজগুলি করতেন।
আপনি কিভাবে উত্তর দেবেন?
◻ কেন যীশু তাঁর সম্ভাব্য অনুগামীদের শিষ্য হওয়ার মূল্য হিসাব করার পরামর্শ দিয়েছিলেন?
◻ ন-যিহূদীদের সম্বন্ধে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি যিহূদীধর্মের উপর কোন্ প্রভাব ফেলেছিল এবং আমরা এর থেকে কী শিখি?
◻ প্রাথমিক বিশ্বস্ত খ্রীষ্টানেরা কোন্ তিন শ্রেণীর লোকেদের কাছ থেকে বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিলেন?
◻ কোন্ দুটি কারণে প্রাথমিক খ্রীষ্টানেরা রোমীয়দের কাছে “ঘৃণিত” হয়েছিলেন?
[১১ পৃষ্ঠার বাক্স]
‘সকলের প্রতি সৎকর্ম্ম করা’
‘সকলের প্রতি সৎকর্ম্ম কর,’ বাইবেলের এই পরামর্শটিকে মেনে চলার জন্য যিহোবার সাক্ষীরা প্রাণপণ চেষ্টা করেন। (গালাতীয় ৬:১০) প্রয়োজনের সময়, প্রতিবেশীদের প্রতি ভালবাসা তাদেরকে অন্য ধর্মের ব্যক্তিদের সাহায্য করতে প্রেরণা যোগায়। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডার সংকটময় পরিস্থিতিতে, ইউরোপের সাক্ষীরা স্বেচ্ছায় ত্রাণ নিয়ে আফ্রিকায় গিয়েছিলেন। সাহায্য করার জন্য দ্রুত সুসংগঠিত শিবির ও অস্থায়ী হাসপাতালগুলি গড়ে তোলা হয়েছিল। প্রচুর পরিমাণ খাদ্য, বস্ত্র এবং কম্বল বিমানে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যে শরণার্থীরা এই ত্রাণ ব্যবস্থা থেকে উপকৃত হয়েছিলেন তাদের সংখ্যা ওই এলাকার যিহোবার সাক্ষীদের থেকে তিন গুণ ছিল।
[৯ পৃষ্ঠার চিত্র]
সুসমাচার প্রচার কাজে প্রথম শতাব্দীর খ্রীষ্টানদের উদ্যোগ কখনও কমে যায়নি