অধ্যায় ২৪
কোনো কিছুই “ঈশ্বরের প্রেম হইতে আমাদিগকে পৃথক্ করিতে” পারে না
১. কোন নেতিবাচক অনুভূতি কিছু সত্য খ্রিস্টান সহ অনেক লোককে কষ্ট দেয়?
যিহোবা ঈশ্বর কি আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে ভালবাসেন? কেউ কেউ মেনে নেয় যে, ঈশ্বর সমস্ত মানবজাতিকে ভালবাসেন, যেমন যোহন ৩:১৬ পদ বলে। কিন্তু, বস্তুত তারা মনে করে: ‘ঈশ্বর আমাকে ব্যক্তিগতভাবে কখনোই ভালবাসেন না।’ এমনকি সত্য খ্রিস্টানদেরও কখনও কখনও এই বিষয়ে সন্দেহ থাকতে পারে। একজন নিরুৎসাহিত ব্যক্তি বলেছিলেন: “ঈশ্বর আদৌ আমার বিষয়ে চিন্তা করেন, তা বিশ্বাস করতে আমার খুবই কষ্ট হয়।” এইরকম সন্দেহ কি মাঝে মাঝে আপনাকেও কষ্ট দেয়?
২, ৩. কে আমাদের মধ্যে এই বিশ্বাস করাতে চায় যে আমরা যিহোবার চোখে মূল্যহীন বা তিনি আমাদের ভালবাসেন না আর আমরা সেই ধারণার সঙ্গে কীভাবে লড়াই করতে পারি?
২ শয়তান আমাদের এই বিশ্বাস করাতে মরিয়া যে, যিহোবা ঈশ্বর আমাদের ভালবাসেন না বা মূল্যও দেন না। এটা ঠিক যে, শয়তান প্রায়ই লোকেদের তাদের আত্মশ্লাঘা ও অহংকারের প্রতি আকৃষ্ট করার দ্বারা বিপথে চালিত করে। (২ করিন্থীয় ১১:৩) কিন্তু সেইসঙ্গে সে দুর্বল ব্যক্তিদের আত্মসম্মান চূর্ণ করেও আনন্দ পায়। (যোহন ৭:৪৭-৪৯; ৮:১৩, ৪৪) আর এটা বিশেষ করে এই সংকটময় শেষকালে করা হচ্ছে। আজকে অনেকে এমন পরিবারে বড় হয়, যেখানে ‘স্নেহ’ নেই। আর অন্যেরা সবসময় এমন লোকেদের মুখোমুখি হয়, যারা হিংস্র, স্বার্থপর এবং দুঃসাহসী। (২ তীমথিয় ৩:১-৫) বছরের পর বছর ধরে খারাপ ব্যবহার, বর্ণবৈষম্য ও ঘৃণার শিকার হওয়ায় এইরকম লোকেদের মনে এই ধারণা জন্মাতে পারে যে, তাদের কোনো মূল্য নেই এবং কেউ তাদের ভালবাসতে পারে না।
৩ আপনার মধ্যেও যদি এইরকম নেতিবাচক অনুভূতি থাকে, তা হলে হতাশ হবেন না। আমাদের মধ্যে অনেকেই মাঝে মাঝে অযথাই নিজেদের দোষী মনে করি। কিন্তু মনে রাখবেন যে, ঈশ্বরের বাক্যকে “সংশোধনের” এবং “দুর্গসমূহ ভাঙ্গিয়া ফেলিবার [“দৃঢ়ভাবে স্থাপিত বিষয়গুলোকে উপড়ে ফেলার,” NW]” জন্য তৈরি করা হয়েছে। (২ তীমথিয় ৩:১৬; ২ করিন্থীয় ১০:৪) বাইবেল বলে: “তাঁহার সাক্ষাতে আপনাদের হৃদয় আশ্বাসযুক্ত করিব, কারণ আমাদের হৃদয় যদি আমাদিগকে দোষী করে, ঈশ্বর আমাদের হৃদয় অপেক্ষা মহান্, এবং সকলই জানেন।” (১ যোহন ৩:১৯, ২০) আসুন আমরা চারটে উপায় দেখি, যেগুলোর মাধ্যমে শাস্ত্র যিহোবার প্রেম সম্বন্ধে আমাদের ‘হৃদয়কে আশ্বাসযুক্ত’ করতে সাহায্য করে।
যিহোবা আপনাকে মূল্য দেন
৪, ৫. চড়ুই পাখি সম্বন্ধে যিশুর দৃষ্টান্ত কীভাবে দেখায় যে, যিহোবার চোখে আমাদের মূল্য আছে?
৪ প্রথমত, বাইবেল সরাসরি শিক্ষা দেয় যে ঈশ্বর তাঁর প্রত্যেক দাসকে মূল্যবান হিসেবে দেখেন। উদাহরণ হিসেবে, যিশু বলেছিলেন: “দুইটী চড়াই পাখী কি এক পয়সায় বিক্রয় হয় না? আর তোমাদের পিতার অনুমতি বিনা তাহাদের একটীও ভূমিতে পড়ে না। কিন্তু তোমাদের মস্তকের কেশগুলিও সমস্ত গণিত আছে। অতএব ভয় করিও না, তোমরা অনেক চড়াই পাখী হইতে শ্রেষ্ঠ।” (মথি ১০:২৯-৩১) যিশুর প্রথম শতাব্দীর শ্রোতাদের কাছে এই কথাগুলোর মানে কী ছিল, তা বিবেচনা করুন।
৫ আমরা হয়তো ভাবতে পারি যে, কেন একজন ব্যক্তি একটা চড়ুই পাখি কিনবে। যিশুর দিনে, যে-পাখিগুলো খাদ্য হিসেবে বিক্রি হতো, সেগুলোর মধ্যে চড়ুই ছিল সবচেয়ে সস্তা। লক্ষ করুন যে, কম মূল্যের একটা মুদ্রা দিয়ে একজন ক্রেতা দুটো চড়ুই পাখি কিনতে পারত। কিন্তু যিশু পরে বলেছিলেন যে, একজন ব্যক্তি যদি দুটো মুদ্রা ব্যয় করতে পারতেন, তা হলে তিনি চারটে নয় কিন্তু পাঁচটা চড়ুই পাখি পেতেন। বাড়তি পাখিটা দিয়ে দেওয়া হতো যেন এর কোনো মূল্যই নেই। লোকেদের চোখে এই পাখিগুলো হয়তো মূল্যহীন ছিল কিন্তু সৃষ্টিকর্তা সেগুলোকে কীভাবে দেখতেন? যিশু বলেছিলেন: “তাহাদের মধ্যে একটীও [এমনকি অতিরিক্তটাও] ঈশ্বরের দৃষ্টিগোচরে গুপ্ত নয়।” (লূক ১২:৬, ৭) এখন আমরা হয়তো যিশুর যুক্তিটা বুঝতে শুরু করেছি। যিহোবা যদি একটা চড়ুই পাখিকে এত মূল্য দেন, তা হলে একজন মানুষ আরও কত বেশি মূল্যবান! যিশু যেমন ব্যাখ্যা করেছিলেন, যিহোবা আমাদের সম্বন্ধে খুঁটিনাটি সমস্তকিছু জানেন। এমনকি, আমাদের মাথার চুলগুলোও গণিত আছে!
৬. আমরা কেন নিশ্চিত হতে পারি যে, যিশু যখন আমাদের মাথার চুল গণিত আছে বলেছিলেন তখন তিনি বাস্তববাদী ছিলেন?
৬ আমাদের চুলগুলোও গণিত? কেউ কেউ হয়তো মনে করতে পারে যে যিশু এখানে অবাস্তব কিছু বলেছিলেন। কিন্তু, শুধু পুনরুত্থানের আশার কথা ভেবে দেখুন। পুনরায় সৃষ্টি করার জন্য যিহোবা আমাদের কত অন্তরঙ্গভাবেই না জানেন! তিনি আমাদের এত বেশি মূল্য দেন যে আমাদের খুঁটিনাটি সমস্তকিছু তিনি জানেন, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে আমাদের বংশানুসংকেত ও আমাদের সারাজীবনের বিভিন্ন স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা।a সেই তুলনায় আমাদের চুলগণনা করা এক সাধারণ কাজ কারণ বেশির ভাগ লোকের মাথায় গড়ে প্রায় ১,০০,০০০টা চুল গজায়।
যিহোবা আমাদের মধ্যে কী দেখেন?
৭, ৮. (ক) যিহোবা মানুষের হৃদয় অনুসন্ধান করার সময় কোন গুণগুলো খুঁজে পেয়ে আনন্দিত হন? (খ) আমাদের এমন কিছু কাজ কী, যেগুলোকে যিহোবা মূল্য দেন?
৭ দ্বিতীয়ত, বাইবেল আমাদের শিক্ষা দেয় যে যিহোবা তাঁর দাসদের কোন বিষয়গুলোকে মূল্য দেন। সহজ ভাষায় বলা যায় যে, তিনি আমাদের ভাল গুণগুলো এবং আমাদের প্রচেষ্টায় আনন্দিত হন। রাজা দায়ূদ তাঁর পুত্র শলোমনকে বলেছিলেন: “সদাপ্রভু সমস্ত অন্তঃকরণের অনুসন্ধান করেন, ও চিন্তার সমস্ত কল্পনা বুঝেন।” (১ বংশাবলি ২৮:৯) এই হিংস্র, ঘৃণাপূর্ণ জগতে ঈশ্বর যখন কোটি কোটি মানুষের হৃদয় অনুসন্ধান করেন, তখন শান্তি, সত্য ও ধার্মিকতা ভালবাসে এমন এক হৃদয় খুঁজে পেলে তিনি কতই না আনন্দিত হন! ঈশ্বর যখন এমন এক হৃদয় খুঁজে পান, যা তাঁর জন্য প্রেমে পূর্ণ, তাঁর সম্বন্ধে জানতে চায় এবং অন্যদের এই জ্ঞান জানাতে চায়, তখন কী হয়? যিহোবা আমাদের বলেন যে, তিনি তাদের লক্ষ করেন যারা তাঁর সম্বন্ধে অন্যদের বলেন। ‘যাহারা সদাপ্রভুকে ভয় করে, ও তাঁহার নাম ধ্যান’ করে তাদের সকলের জন্য এমনকি তাঁর “একখানি স্মরণার্থক পুস্তক” রয়েছে। (মালাখি ৩:১৬) এই ধরনের গুণগুলো তাঁর কাছে মূল্যবান।
৮ কিছু ভাল কাজ কী, যেগুলোকে যিহোবা মূল্য দেন? নিঃসন্দেহে তাঁর পুত্র, যিশু খ্রিস্টকে অনুকরণ করার জন্য আমাদের প্রচেষ্টা। (১ পিতর ২:২১) একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ যে-কাজকে ঈশ্বর মূল্য দেন, তা হল তাঁর রাজ্যের সুসমাচার ছড়িয়ে দেওয়া। রোমীয় ১০:১৫ পদে আমরা পড়ি: “যাহারা মঙ্গলের সুসমাচার প্রচার করে, তাহাদের চরণ কেমন শোভা পায়।” আমরা হয়তো স্বাভাবিকভাবে আমাদের হীন পা দুটোকে ‘শোভাময়’ বা সুন্দর বলে চিন্তা করতে পারি না। কিন্তু এখানে সেগুলো সুসমাচার প্রচারে যিহোবার দাসদের প্রচেষ্টাকে প্রতিনিধিত্ব করে। এই সমস্ত প্রচেষ্টা তাঁর চোখে সুন্দর ও মূল্যবান।—মথি ২৪:১৪; ২৮:১৯, ২০.
৯, ১০. (ক) কেন আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি যে, বিভিন্ন কষ্টের মধ্যে আমরা যে স্থির থাকি সেটাকে যিহোবা মূল্য দেন? (খ) যিহোবা তাঁর বিশ্বস্ত দাসদের সম্বন্ধে কোন নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি কখনোই রাখেন না?
৯ যিহোবা আমাদের স্থির থাকাকেও মূল্য দেন। (মথি ২৪:১৩) মনে রাখবেন যে, শয়তান চায় যেন আপনি যিহোবাকে পরিত্যাগ করেন। একেকটা দিন যিহোবার প্রতি আনুগত্য বজায় রেখে আপনি তাঁকে শয়তানের টিটকারির উত্তর দিতে সাহায্য করছেন। (হিতোপদেশ ২৭:১১) কখনও কখনও স্থির থাকা সহজ ব্যাপার নয়। স্বাস্থ্যগত সমস্যা, অর্থনৈতিক সমস্যা, মানসিক চাপ এবং অন্যান্য বাধা প্রতিটা দিনকে একটা পরীক্ষা করে তুলতে পারে। আমরা যা আশা করি, তা পেতে বিলম্ব হওয়া নিরুৎসাহিত করতে পারে। (হিতোপদেশ ১৩:১২) এইরকম প্রতিদ্বন্দ্বিতাগুলোর মুখে স্থির থাকা যিহোবার কাছে আরও বেশি মূল্যবান। এই কারণেই রাজা দায়ূদ তার চোখের জল “কুপাতে” জমা রাখতে যিহোবাকে অনুরোধ করেছিলেন আর আস্থার সঙ্গে বলেছিলেন: “তাহা কি তোমার পুস্তকে লিখিত নাই?” (গীতসংহিতা ৫৬:৮) হ্যাঁ, তাঁর প্রতি আনুগত্য বজায় রাখার সময় আমরা যত চোখের জল ফেলি এবং কষ্ট ভোগ করি, সেগুলোর সমস্তই যিহোবা মূল্য দেন। তাঁর চোখে এগুলোও মূল্যবান।
পরীক্ষাগুলোর মুখে আমাদের স্থির থাকাকে যিহোবা মূল্য দেন
১০ এখন, নিজেকে দোষী করে এমন হৃদয় হয়তো ঈশ্বরের চোখে যে আমরা মূল্যবান, সেই প্রমাণ দেখার ক্ষেত্রে বাধা দিতে পারে। এটা হয়তো ক্রমাগত বলতে পারে: ‘কিন্তু এমন অনেকে আছে, যারা আমার চেয়ে বেশি উদাহরণযোগ্য। যিহোবা যখন তাদের সঙ্গে আমার তুলনা করেন, তখন কতই না হতাশ হন!’ যিহোবা তুলনা করেন না বা তিনি তাঁর চিন্তায় অনমনীয় বা কঠোরও নন। (গালাতীয় ৬:৪) তিনি খুবই সূক্ষ্মভাবে আমাদের হৃদয় পড়েন এবং আমাদের মধ্যে এমনকি অতি ক্ষুদ্র ভাল কিছু থাকলেও সেটাকে মূল্য দেন।
যিহোবা মন্দ থেকে ভালকে পৃথক করেন
১১. অবিয়ের বিষয়টা যিহোবা যেভাবে পরিচালনা করেছিলেন, সেটা থেকে তাঁর সম্বন্ধে আমরা কী জানতে পারি?
১১ তৃতীয়ত, যিহোবা আমাদের হৃদয় অনুসন্ধান করার সময় ভাল কিছু খুঁজে পাওয়ার জন্য খুব সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা করেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, যিহোবা যখন রাজা যারবিয়ামের পুরো ধর্মভ্রষ্ট রাজবংশের প্রতি শাস্তি ঘোষণা করেছিলেন, তখন তিনি আদেশ দিয়েছিলেন যে রাজার ছেলেদের মধ্যে শুধু এক ছেলে অবিয়কে উপযুক্তভাবে কবর দেওয়া হবে। কেন? “ইস্রায়েলের ঈশ্বর সদাপ্রভুর প্রতি তাহার কিঞ্চিৎ সদ্ভাব পাওয়া গিয়াছে।” (১ রাজাবলি ১৪:১, ১০-১৩) বস্তুত, যিহোবা সেই যুবকের হৃদয় খুব সূক্ষ্মভাবে পরীক্ষা করেছিলেন এবং সেখানে “সদ্ভাব” পেয়েছিলেন। সেই সদ্ভাব যত ক্ষুদ্র বা নগণ্যই হোক না কেন, যিহোবা সেটাকে তাঁর বাক্যে উল্লেখ করার যোগ্য মনে করেছিলেন। তিনি এমনকি তা পুরস্কৃত করেছিলেন, এক ধর্মভ্রষ্ট পরিবারের সেই সদস্যের প্রতি উপযুক্ত মাত্রায় করুণা দেখিয়েছিলেন।
১২, ১৩. (ক) রাজা যিহোশাফটের ঘটনা কীভাবে দেখায় যে আমরা যখন পাপ করি এমনকি তখনও যিহোবা আমাদের মধ্যে ভাল কিছু দেখার চেষ্টা করেন? (খ) আমাদের ভাল কাজ ও গুণগুলোর বিষয় যখন আসে, তখন কীভাবে যিহোবা একজন স্নেহময় পিতা হিসেবে কাজ করেন?
১২ ভাল রাজা যিহোশাফটের ক্ষেত্রে হয়তো আরও উল্লেখযোগ্য উদাহরণ পাওয়া যেতে পারে। রাজা যখন বোকার মতো একটা কাজ করেছিলেন, তখন যিহোবার ভাববাদী তাঁকে বলেছিলেন: “এ জন্য সদাপ্রভু হইতে আপনার উপরে ক্রোধ বর্ত্তিল।” কী এক গুরুতর কথা! কিন্তু যিহোবার বার্তা সেখানেই শেষ হয়ে যায়নি। এটা বলে চলেছিল: “যাহা হউক, আপনার মধ্যে কোন কোন সাধু ভাব পাওয়া গিয়াছে।” (২ বংশাবলি ১৯:১-৩) অতএব, যিহোবার ন্যায্য ক্রোধ তাঁকে যিহোশাফটের মধ্যে ভাল কিছু দেখা থেকে অন্ধ করে রাখেনি। অসিদ্ধ মানুষেরা কতই না আলাদা! আমরা যখন অন্যদের ওপর বিরক্ত হই, তখন হয়তো তাদের মধ্যে ভাল কিছু দেখতে চাই না। আর আমরা যখন পাপ করি, তখন হতাশা, লজ্জা ও অপরাধবোধ হয়তো আমাদের নিজেদের মধ্যে ভাল কিছু দেখার বিষয়ে অন্ধ করে রাখতে পারে। কিন্তু মনে রাখবেন যে, আমরা যদি আমাদের পাপের জন্য অনুতপ্ত হই এবং সেগুলো আবারও না করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করি, তা হলে যিহোবা আমাদের ক্ষমা করেন।
১৩ যিহোবা যখন সূক্ষ্মভাবে আপনাকে পরীক্ষা করেন, তখন একজন সোনাসন্ধানী যেমন সোনার জন্য মূল্যহীন কাঁকর অগ্রাহ্য করে, তেমনই তিনি এইরকম পাপগুলোকে অগ্রাহ্য করেন। আপনার ভাল গুণ এবং কাজগুলো সম্বন্ধে কী বলা যায়? হ্যাঁ, এগুলোই হল “সোনার কণা” যেগুলো যিহোবা মনে রাখেন! আপনি কি কখনও লক্ষ করেছেন যে, স্নেহপরায়ণ বাবামারা কীভাবে তাদের সন্তানদের আঁকা ছবি বা স্কুলে করা প্রকল্পগুলোকে মূল্যবান মনে করে রেখে দেয়, মাঝে মাঝে সন্তানেরা সেগুলো ভুলে যাওয়ার দীর্ঘ সময় পরেও? যিহোবা হলেন সবচেয়ে স্নেহময় পিতা। যতদিন পর্যন্ত আমরা তাঁর প্রতি বিশ্বস্ত থাকি, তিনি কখনোই আমাদের ভাল কাজ ও গুণগুলো ভুলে যান না। সত্যি বলতে কী, তিনি এগুলো ভুলে যাওয়াকে অন্যায় বলে মনে করবেন আর তিনি কখনোই অন্যায়কারী নন। (ইব্রীয় ৬:১০) তিনি আরেক উপায়েও আমাদের সূক্ষ্মভাবে পরীক্ষা করেন।
১৪, ১৫. (ক) কেন আমাদের অসিদ্ধতা কখনও আমাদের মধ্যে ভাল কিছু দেখার বিষয়ে যিহোবাকে অন্ধ করে রাখে না? উদাহরণের সাহায্যে ব্যাখ্যা করুন। (খ) যিহোবা আমাদের মধ্যে যে-ভাল গুণগুলো খুঁজে পান, তা নিয়ে তিনি কী করবেন এবং তিনি তাঁর বিশ্বস্ত লোকেদের কীভাবে দেখেন?
১৪ যিহোবা আমাদের অসিদ্ধতা অতিক্রম করে দেখেন এবং আমাদের মধ্যে সম্ভাবনা খোঁজেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়: যে-লোকেরা শিল্পকর্ম ভালবাসে, তারা অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত চিত্র বা অন্যান্য শিল্পকর্ম মেরামত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। উদাহরণস্বরূপ, ইংল্যান্ডের লন্ডনে অবস্থিত ন্যাশনাল গ্যালারিতে কোনো ব্যক্তি যখন একটা শটগান দিয়ে প্রায় ৩ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির আঁকা একটা ছবি নষ্ট করে দিয়েছিল, তখন কেউই বলেনি যে এই ছবিটা যেহেতু নষ্ট হয়ে গেছে, তাই এটাকে ফেলে দেওয়াই উচিত। প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম মেরামত করার কাজ সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। কেন? কারণ শিল্পকর্ম প্রেমিকদের চোখে এটা অত্যন্ত মূল্যবান ছিল। আপনি কি চক এবং কাঠকয়লার আঁকা একটা ছবির চেয়ে আরও বেশি মূল্যবান নন? ঈশ্বরের চোখে আপনি অবশ্যই মূল্যবান—উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া অসিদ্ধতার দ্বারা যত ক্ষতিগ্রস্তই আপনি হোন না কেন। (গীতসংহিতা ৭২:১২-১৪) মানবপরিবারের দক্ষ সৃষ্টিকর্তা, যিহোবা ঈশ্বর যারা তাঁর প্রেমময় যত্নের প্রতি সাড়া দেয়, তাদের সকলকে সিদ্ধতায় ফিরিয়ে আনার জন্য যা প্রয়োজন তা-ই করবেন।—প্রেরিত ৩:২১; রোমীয় ৮:২০-২২.
১৫ হ্যাঁ, যিহোবা আমাদের মধ্যে ভাল কিছু দেখেন, যা হয়তো আমরা দেখতে পারি না। আর আমরা যখন তাঁর সেবা করে চলব, তখন তিনি আমরা সিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের মধ্যে ভাল গুণকে বৃদ্ধি করে চলবেন। শয়তানের জগৎ আমাদের সঙ্গে যেরকম আচরণই করুক না কেন, যিহোবা তাঁর বিশ্বস্ত দাসদের মনোরঞ্জনের বস্তু হিসেবে মূল্য দেন।—হগয় ২:৭.
যিহোবা সক্রিয়ভাবে তাঁর প্রেম প্রদর্শন করেন
১৬. আমাদের প্রতি যিহোবার প্রেমের সবচেয়ে বড় প্রমাণ কী এবং কীভাবে আমরা জানি যে, এই দান আমাদের জন্য ব্যক্তিগতভাবে অর্থ রাখে?
১৬ চতুর্থত, যিহোবা আমাদের প্রতি তাঁর প্রেম প্রমাণ করার জন্য অনেক কিছু করেন। নিশ্চিতভাবেই, খ্রিস্টের মুক্তির মূল্যরূপ বলিদান হল শয়তানের উত্থাপিত এই মিথ্যা যে আমাদের কোনো মূল্য নেই ও আমরা ভালবাসা পাওয়ার অযোগ্য, সেটার সবচেয়ে কার্যকর উত্তর। আমাদের কখনও ভুলে যাওয়া উচিত নয়, যাতনাদণ্ডের ওপর যিশু যে-যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুবরণ করেছিলেন এবং যিহোবা তাঁর প্রিয় পুত্রকে মৃত্যুবরণ করতে দেখার সময় এর চেয়েও যে-বড় যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন, তা আমাদের প্রতি তাঁদের প্রেমের সবচেয়ে বড় প্রমাণ। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, অনেকের বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, এই দান তাদের জন্য ব্যক্তিগতভাবে অর্থ রাখতে পারে। তারা নিজেদের অযোগ্য বলে মনে করে। কিন্তু মনে করে দেখুন যে, প্রেরিত পৌল একসময় খ্রিস্টের অনুসারীদের তাড়নাকারী ছিলেন। তবুও, তিনি লিখেছিলেন: ‘ঈশ্বরের পুত্ত্র . . . আমাকে প্রেম করিলেন, এবং আমার নিমিত্তে আপনাকে প্রদান করিলেন।’ (বাঁকা অক্ষরে মুদ্রণ আমাদের।)—গালাতীয় ১:১৩; ২:২০.
১৭. কীসের মাধ্যমে যিহোবা আমাদেরকে তাঁর ও তাঁর পুত্রের প্রতি আকর্ষণ করেন?
১৭ যিহোবা আমাদের প্রত্যেককে খ্রিস্টের বলিদানের উপকারগুলোর সুযোগ নিতে সাহায্য করার দ্বারা আমাদের প্রতি তাঁর প্রেম প্রমাণ করেন। যিশু বলেছিলেন: “পিতা, যিনি আমাকে পাঠাইয়াছেন, তিনি আকর্ষণ না করিলে কেহ আমার কাছে আসিতে পারে না।” (যোহন ৬:৪৪) হ্যাঁ, যিহোবা আমাদের ব্যক্তিগতভাবে তাঁর পুত্রের এবং অনন্তজীবনের আশার প্রতি আকর্ষণ করেন। কীভাবে? প্রচার কাজের মাধ্যমে, যা আমাদের প্রত্যেকের কাছে পৌঁছে এবং তাঁর পবিত্র আত্মার মাধ্যমে, যা যিহোবা আমাদের সীমাবদ্ধতা ও অসিদ্ধতাগুলো সত্ত্বেও, আধ্যাত্মিক সত্যগুলো বুঝতে ও কাজে লাগাতে সাহায্য করার জন্য ব্যবহার করেন। তাই, যিহোবা আমাদের সম্বন্ধে একই কথা বলতে পারেন, যা তিনি ইস্রায়েল জাতি সম্বন্ধে বলেছিলেন: “আমি ত চিরপ্রেমে তোমাকে প্রেম করিয়া আসিতেছি, এই জন্য আমি তোমার প্রতি চিরস্থায়ী দয়া করিলাম।”—যিরমিয় ৩১:৩.
১৮, ১৯. (ক) সবচেয়ে অন্তরঙ্গ উপায় কী, যেটার মাধ্যমে যিহোবা আমাদের প্রতি তাঁর প্রেম প্রদর্শন করেন আর কী দেখায় যে তিনি নিজে এর যত্ন নেন? (খ) ঈশ্বরের বাক্য কীভাবে আমাদের আশ্বস্ত করে যে, যিহোবা একজন সহমর্মী শ্রোতা?
১৮ প্রার্থনার যে-বিশেষ সুযোগ আমাদের রয়েছে, সম্ভবত সেটার মাধ্যমে আমরা যিহোবার প্রেম সবচেয়ে অন্তরঙ্গভাবে উপলব্ধি করি। বাইবেল আমাদের প্রত্যেককে ঈশ্বরের কাছে “অবিরত প্রার্থনা” করতে আমন্ত্রণ জানায়। (১ থিষলনীকীয় ৫:১৭) তিনি শোনেন। তাঁকে এমনকি “প্রার্থনা-শ্রবণকারী” বলা হয়। (গীতসংহিতা ৬৫:২) এই অধিকার তিনি অন্য আর কাউকে দেননি, এমনকি তাঁর নিজ পুত্রকেও নয়। ভেবে দেখুন: বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা মন খুলে প্রার্থনার মাধ্যমে, আমাদের তাঁর নিকটবর্তী হতে বলছেন। তিনি কী ধরনের শ্রোতা? আবেগহীন, উদাসীন, যত্নহীন? কখনোই নয়।
১৯ যিহোবা সহমর্মী। সহমর্মিতা কী? একজন বিশ্বস্ত বয়স্ক খ্রিস্টান বলেছিলেন: “সহমর্মিতা হল আমার হৃদয়ে আপনার ব্যথা।” যিহোবা কি আমাদের ব্যথার দ্বারা সত্যিই প্রভাবিত হন? আমরা তাঁর প্রজা ইস্রায়েলের দুঃখকষ্ট সম্বন্ধে পড়ি: “তাহাদের সকল দুঃখে তিনি দুঃখিত হইতেন।” (যিশাইয় ৬৩:৯) যিহোবা শুধু তাদের সমস্যাই দেখেননি; তিনি লোকেদের জন্য অনুভব করেছিলেন। তিনি কতটা গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন, তা তাঁর দাসদের প্রতি যিহোবার নিজের বাক্যের দ্বারা বর্ণিত হয়: “যে ব্যক্তি তোমাদিগকে স্পর্শ করে, সে তাঁহার [“আমার,” NW] চক্ষুর তারা স্পর্শ করে।”b (সখরিয় ২:৮) তা কতই না বেদনাদায়ক হবে! হ্যাঁ, যিহোবা আমাদের জন্য অনুভব করেন। আমরা যখন কষ্ট পাই, তখন তিনিও কষ্ট পান।
২০. আমরা যদি রোমীয় ১২:৩ পদের পরামর্শ মেনে চলতে চাই, তা হলে আমাদের অবশ্যই কোন ভারসাম্যহীন চিন্তা এড়িয়ে চলতে হবে?
২০ কোনো ভারসাম্যপূর্ণ খ্রিস্টানই ঈশ্বরের প্রেম এবং উচ্চমূল্য দেওয়ার এইরকম প্রমাণকে গর্ব বা অহংকার করার এক অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করবে না। প্রেরিত পৌল লিখেছিলেন: “আমাকে যে অনুগ্রহ দত্ত হইয়াছে, তাহার গুণে আমি তোমাদের মধ্যবর্ত্তী প্রত্যেক জনকে বলিতেছি, আপনার বিষয়ে যেমন বোধ করা উপযুক্ত, কেহ তদপেক্ষা বড় বোধ না করুক; কিন্তু ঈশ্বর যাহাকে যে পরিমাণে বিশ্বাস বিতরণ করিয়াছেন, তদনুসারে সে সুবোধ হইবারই চেষ্টায় আপনার বিষয়ে বোধ করুক।” (রোমীয় ১২:৩) আরেকটা অনুবাদ এখানে বলে: “আমি তোমাদের প্রত্যেককে বলছি যে তোমরা নিজেদেরকে তোমাদের প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত মূল্যবান মনে কোরো না বরং নিজেকে পরিমিত মূল্যে মূল্যায়ন করো।” (চার্লস বি. উইলিয়ামস্ কর্তৃক এ ট্রান্সলেশন ইন দ্যা ল্যাংগুয়েজ অফ দ্যা পিপল) অতএব আমাদের স্বর্গীয় পিতার প্রেমের উষ্ণতা পূর্ণরূপে উপভোগ করার সময় আসুন আমরা সুবোধ হই এবং মনে রাখি যে আমরা ঈশ্বরের প্রেম অর্জন করতে পারি না বা সেটার যোগ্যও নই।—লূক ১৭:১০.
২১. শয়তানের কোন মিথ্যাগুলোকে আমাদের সবসময় প্রতিরোধ করে চলতে হবে এবং কোন ঐশিক সত্যের দ্বারা আমরা আমাদের হৃদয়কে আশ্বস্ত করে চলতে পারি?
২১ আসুন আমরা প্রত্যেকে শয়তানের সমস্ত মিথ্যাকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য আমাদের যথাসাধ্য করি, যেগুলোর অন্তর্ভুক্ত সেই মিথ্যাও যে, আমরা মূল্যহীন ও ভালবাসা পাওয়ার অযোগ্য। আপনার জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো যদি আপনাকে এমন এক সমস্যা হিসেবে দেখতে শেখায় যা এমনকি ঈশ্বরের প্রগাঢ় প্রেমও অতিক্রম করতে পারে না বা আপনার ভাল কাজগুলোকে এত নগণ্য বলে মনে করায় যে, তাঁর সর্বদর্শী চোখ তা দেখতে পায় না কিংবা আপনার পাপগুলোকে এত বড় বলে মনে করায় যে, এমনকি তাঁর পুত্রের মৃত্যুও সেটাকে আচ্ছাদন করতে পারে না, তা হলে আপনাকে এক মিথ্যা শেখানো হয়েছে। এই মিথ্যাগুলোকে মনেপ্রাণে প্রত্যাখ্যান করুন! আসুন আমরা পৌলের অনুপ্রাণিত বাক্যগুলোতে প্রকাশিত সত্যের দ্বারা আমাদের হৃদয়কে আশ্বস্ত করে চলি: “আমি নিশ্চয় জানি, কি মৃত্যু, কি জীবন, কি দূতগণ, কি আধিপত্য সকল, কি উপস্থিত বিষয় সকল, কি ভাবী বিষয় সকল, কি পরাক্রম সকল, কি ঊর্দ্ধ্ব স্থান, কি গভীর স্থান, কি অন্য কোন সৃষ্ট বস্তু কিছুই আমাদের প্রভু খ্রিস্ট যিশুতে অবস্থিত ঈশ্বরের প্রেম হইতে আমাদিগকে পৃথক্ করিতে পারিবে না।”—রোমীয় ৮:৩৮, ৩৯.
a বাইবেল বার বার পুনরুত্থানের আশাকে যিহোবার স্মৃতির সঙ্গে যুক্ত করে। বিশ্বস্ত ব্যক্তি ইয়োব যিহোবাকে বলেছিলেন: “হায়, . . . আমার জন্য সময় নিরূপণ কর, আমাকে স্মরণ কর।” (বাঁকা অক্ষরে মুদ্রণ আমাদের।) (ইয়োব ১৪:১৩) যিশু ‘কবরস্থ [“স্মরণিক কবরের,” NW] সকলের’ পুনরুত্থান সম্বন্ধে বলেছিলেন। এটা উপযুক্ত ছিল কারণ যিহোবা যেসমস্ত মৃত ব্যক্তিকে পুনরুত্থিত করতে চান, তাদের সকলকে তিনি নিখুঁতভাবে মনে রাখেন।—যোহন ৫:২৮, ২৯.
b কিছু অনুবাদ এখানে ইঙ্গিত করে যে, যে-ব্যক্তি ঈশ্বরের লোকেদের স্পর্শ করে সে তার নিজের চোখ বা ইস্রায়েলের চোখ স্পর্শ করছে, ঈশ্বরের চোখ নয়। এই ভুলটা কিছু ধর্মগুরু শুরু করেছিলেন, যারা এই অংশটাকে অসম্মানজনক বলে মনে করেছিল আর তাই এটাকে পরিবর্তন করেছিল। তাদের ভ্রান্ত প্রচেষ্টা যিহোবার ব্যক্তিগত সহমর্মিতার তীব্রতাকে গুপ্ত রেখেছিল।