শিখিম—উপত্যকার নগরটি
সেই দেশটির অন্তরস্থ স্থানে যেটি ঈশ্বর তার লোকেদের জন্য নির্বাচিত করেছিলেন, এবল ও গরিষীম পর্বতের মধ্যবর্তী স্থানে সুরক্ষিত নগর শিখিম অবস্থিত। এই ছিল সেই স্থান যেখানে—প্রায় চার হাজার বছর আগে—যখন যিহোবা অব্রাহামের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন: “আমি তোমার বংশকে এই দেশ দিব।”—আদিপুস্তক ১২:৬, ৭.
এই প্রতিজ্ঞার সাথে মিল রেখে, অব্রাহামের পৌত্র যাকোব, শিখিমে শিবির স্থাপন এবং একটি যজ্ঞবেদি নির্মাণ করেছিলেন যেটির নাম তিনি রেখেছিলেন “ঈশ্বর, ইস্রায়েলের ঈশ্বর।” সম্ভবত যাকোব তার পরিবার এবং পশুপালের নিমিত্ত জল সরবরাহের জন্য এই অঞ্চলে একটি কূপ খনন করেছিলেন, যে কূপটি কয়েক শতাব্দী পরেও “যাকোবের কূপ” নামে পরিচিত হত।—আদিপুস্তক ৩৩:১৮-২০, পাদটীকা, NW; যোহন ৪:৫, ৬, ১২.
কিন্তু, যাকোবের পরিবারের সমস্ত সদস্যেরা সত্য উপাসনার প্রতি উদ্যোগ দেখায়নি। তার কন্যা দীণা, শিখিমের কনানীয় কন্যাদের মধ্যে সঙ্গী খুঁজতে যায়। দীণা যে তখনও যুবতী ছিল, তার পরিবারের নিরাপদ তাঁবুগুলি ছেড়ে পার্শ্ববর্তী নগরে যাতায়াত শুরু করে ও সেখানে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে।
নগরের যুবকেরা এই যুবতী কুমারীকে কোন্ দৃষ্টিতে দেখবে যে তাদের শহরে নিয়মিত যাতায়াত করত—আপাতদৃষ্টিতে সঙ্গিহীনভাবে? একজন দেশাধিপতির পুত্র “তাহাকে দেখিতে পাইল এবং তাহাকে হরণ করিয়া তাহার সহিত শয়ন করিল, তাহাকে ভ্রষ্ট করিল।” দীণা কেন নীতিহীন কনানীয়দের সাথে মেলামেশা করে বিপদ ডেকে এনেছিল? তার মত সমবয়সী মেয়েদের সঙ্গ পাবার অনুভূতিই কি এর কারণ ছিল? সে কি তার কোন কোন ভাইয়েদের মত একগুঁয়ে এবং স্বাধীনচেতা ছিল? আদিপুস্তকের বিবরণটি পড়ুন এবং তাদের কন্যার শিখিমে যাতায়াত করার নিদারুণ পরিণতির কারণে যাকোব ও লেয়াকে অবশ্যই যে কষ্ট এবং লজ্জা পেতে হয়, তা উপলবদ্ধি করার চেষ্টা করুন।—আদিপুস্তক ৩৪:১-৩১; ৪৯৫-৭; এছাড়াও প্রহরীদুর্গ (ইংরাজি), জুন ১৫, ১৯৮৫, পৃষ্ঠা ৩১ দেখুন।
প্রায় ৩০০ বছর পরে, ঐশিক নির্দেশনাবলী অবজ্ঞা করার ফল আরেকবার প্রতীয়মান হয়। শিখিমে যিহোশূয়, ইস্রায়েলীয় ইতিহাসের এক অতি স্মরণীয় সমাবেশের আয়োজন করেছিলেন। উপত্যকায় সেই দৃশ্যটি কল্পনা করুন। দশ লক্ষেরও বেশি লোক—পুরুষ, নারী এবং সন্তানেরা—ইস্রায়েলের ছয় বংশ থেকে আগত লোকেরা গরিষীম পর্বতের সম্মুখে দাঁড়ায়। উপত্যকাটির অপর দিকে একই সংখ্যক অন্যান্য ছয় বংশের লোকেরা এবল পর্বতের সম্মুখে দাঁড়ায়।a আর নিচে নিয়ম সিন্দুকের পাশে এবং ইস্রায়েলীয়দের দুই দলের মাঝখানে যাজকেরা এবং যিহোশূয় দাঁড়ান। কী এক দৃশ্য!—যিহোশূয় পুস্তক ৮:৩০-৩৩.
এই বৃহৎসংখ্যক জনতাকে ছাপিয়ে পর্বত দুটি যেন সৌন্দর্য এবং শূন্যতার এক সূক্ষ্ম বৈসাদৃশ্যের চিত্র তুলে ধরে। যেখানে গরিষীমের উঁচু চূড়াগুলি দেখতে সবুজ এবং উর্বর, সেখানে এবলের সেগুলি প্রধানত ধূসর ও তৃণপত্র শূন্য। যিহোশূয়ের কথা বলার মুহূর্তটির অপেক্ষায় ইস্রায়েলীয়রা আছে সেই উত্তেজনাময় গুঞ্জন কি আপনি অনুভব করতে পারছেন? এই প্রাকৃতিক রঙ্গমঞ্চে প্রতিটি শব্দের প্রতিধ্বনি হচ্ছে।
যিহোশূয় চার থেকে ছয় ঘন্টা ব্যাপী ‘মোশির ব্যবস্থা পুস্তক’ পাঠ করার সময় লোকেরাও তার সাথে অংশ নেয়। (যিহোশূয় ৮:৩৪, ৩৫) দেখা যায় যে, গরিষীমের সম্মুখে ইস্রায়েলীয়রা প্রত্যেকটি আশীর্বাদের পরে আমেন! বলে, পক্ষান্তরে এবলের সম্মুখে যারা ছিল তাদের আমেন! প্রত্যেকটি অভিশাপকে জোর দিয়েছিল। সম্ভবত এবল পর্বতের বন্ধ্যা বাহ্যিক দৃশ্যটি অবাধ্যতার বিপর্যস্ত ফলাফলের কথা লোকেদের স্মরণ করিয়ে দেয়।
“যে কেহ আপন পিতাকে কি মাতাকে অবজ্ঞা করে, সে শাপগ্রস্ত,” যিহোশূয় সতর্ক করেন। দশ লক্ষের বেশি স্বর একসঙ্গে উচ্চরবে বলে: “আমেন!” যিহোশূয় অগ্রসর হওয়ার পূর্বে এই বজ্রধ্বনিতুল্য আওয়াজ ম্লান হয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেন: “যে কেহ আপন প্রতিবাসীর ভূমিচিহ্ন স্থানান্তর করে, সে শাপগ্রস্ত।” আবার একবার এই ছয় গোষ্ঠী যাদের সঙ্গী ছিল অনেক প্রবাসী বসবাসকারী চিৎকার করে বলে: “আমেন!” (দ্বিতীয় বিবরণ ২৭:১৬, ১৭) সেই পর্বতদ্বয়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত সেই সভায় যদি আপনি উপস্থিত থাকতেন তা কি আপনি কখনও ভুলে যেতেন? বাধ্যতার প্রয়োজনীয়তা কি আপনার মনের উপর অমোচনীয়রূপে মুদ্রিত হয়ে থাকত না?
প্রায় ২০ বছর পর তার মৃত্যুর অল্প কিছু পূর্বে, যিহোশূয় এই জাতিকে আরেকবার তাদের সিদ্ধান্তে দৃঢ় থাকতে শক্তিশালী করার জন্য শিখিমে একত্র হওয়ার আহ্বান করেন। তিনি তাদের সম্মুখে মনোনয়নের বিষয়টি রাখেন যা অবশ্যই প্রত্যেককে করতে হবে। তিনি বলেছিলেন “যাহার সেবা করিবে, তাহাকে অদ্য মনোনীত কর। . . . কিন্তু আমি ও আমার পরিজন আমরা সদাপ্রভুর সেবা করিব।” (যিহোশূয় ২৪:১, ১৫) স্পষ্টতই, শিখিমে এই বিশ্বাস-উত্তেজনাকর সম্মেলনগুলি তাদের গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। কারণ যিহোশূয়ের মৃত্যুর বহু বছর পরও, ইস্রায়েলীয়রা তার বিশ্বস্ত উদাহরণ অনুকরণ করেছিল।—যিহোশূয় ২৪:৩১.
প্রায় ১৫ শতাব্দী পরে যখন যীশু গরিষীম পর্বতের ছায়ার নিচে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, তখন এক হৃদয়-উদ্রেককারী কথোপকথন হয়েছিল। দীর্ঘ পথ ভ্রমণের ফলে ক্লান্ত যীশু যাকোবের কূপের পাশে বসেছিলেন যখন একজন শমরীয়া স্ত্রীলোক জলের পাত্র নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়েছিল। যখন যীশু তার কাছে পান করার জল চেয়েছিল, স্ত্রীলোকটি খুবই অবাক হয়েছিল যেহেতু যিহূদীরা শমরীয়দের সাথে কথা বলত না তাই অবশ্যই তাদের পাত্রের জলও পান করত না। (যোহন ৪:৫-৯) যীশুর পরের কথাটি তাকে এমনকি আরও বেশি অবাক করেছিল।
“যে কেহ এই জল পান করে, তাহার আবার পিপাসা হইবে; কিন্তু আমি যে জল দিব, তাহা যে কেহ পান করে, তাহার পিপাসা আর কখনও হইবে না; বরং আমি তাহাকে যে জল দিব, তাহা তাহার অন্তরে এমন জলের উনুই হইবে, যাহা অনন্ত জীবন পর্য্যন্ত উথলিয়া উঠিবে।” (যোহন ৪:১৩, ১৪) এই প্রতিশ্রুতিতে স্ত্রীলোকটির আগ্রহের কথা কল্পনা করুন, যেহেতু এই গভীর কূপ থেকে জল তোলা একটি কষ্টকর কাজ ছিল। যীশু আরও ব্যাখ্যা করেন যে তাদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও ঈশ্বরের নিকটবর্তী হওয়ার জন্য, যিরূশালেম অথবা গরিষীম পর্বত কোন অত্যাবশ্যকীয় ধর্মীয় স্থান ছিল না। স্থান নয়, বরং হৃদয়ের মনোভাব এবং আচরণই ছিল প্রকৃতপক্ষে বিষয়। তিনি বলেছিলেন, “প্রকৃত ভজনাকারীরা আত্মায় ও সত্যে পিতার ভজনা করিবে; . . . বাস্তবিক পিতা এইরূপ ভজনাকারীদেরই অন্বেষণ করেন।” (যোহন ৪:২৩) অবশ্যই ঐ কথাগুলি কতই না সান্ত্বনাদায়ক ছিল! আবারও একবার এই উপত্যকা যিহোবার সেবা করার জন্য লোকেদের পরামর্শ প্রদানের স্থান হয়ে ওঠে।
বর্তমান দিনে নেবলস্ নগরটি বিধ্বস্ত প্রাচীন শিখিমের পাশে অবস্থিত। গরিষীম এবং এবল পর্বত এখনও উপত্যকাটির উপর কর্তৃত্ব করছে এবং অতীতের ঘটনাগুলির নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই পর্বতগুলির মূলে যাকোবের কূপ, যা হয়ত এখনও পরিদর্শন করা যেতে পারে। সেখানে যে সকল ঘটনা ঘটেছিল তা আমরা যখন ধ্যান করি, আমাদের সেটি সত্য উপাসনাকে উচ্চকৃত করার বিষয়টির গুরুত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, ঠিক যেমন যিহোশূয় এবং যীশু আমাদের করতে শিখিয়েছিলেন।—তুলনা করুন যিশাইয় ২:২, ৩.
[পাদটীকাগুলো]
a শিমিয়োন, লেবি, যিহূদা, ইষাখর, যোষেফ ও বিন্যামীন এই ছয় বংশ গরিষীম পর্বতের সম্মুখে ছিল। রূবেণ, গাদ, আশের, সবূলূন, দান ও নপ্তালি, এই ছয় বংশ এবল পর্বতের সম্মুখে ছিল।—দ্বিতীয় বিবরণ ২৭:১২, ১৩.
[৩১ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্যে]
Pictorial Archive (Near Eastern History) Est.