মৃত্যুর পরে জীবন—বাইবেল কী বলে?
“তুমি ধূলি, এবং ধূলিতে প্রতিগমন করিবে।”—আদিপুস্তক ৩:১৯.
১, ২. (ক) মৃত্যুর পরে জীবন সম্পর্কে কোন্ আলাদা আলাদা ধারণা রয়েছে? (খ) মানুষ আসলে কী এই সম্বন্ধে বাইবেলের শিক্ষা জানার জন্য আমাদের কী পরীক্ষা করে দেখা দরকার?
হিন্দু দার্শনিক নিখিলানন্দ বলেছিলেন: “ঈশ্বর যিনি তাঁর সৃষ্টিকে ভালবাসেন তিনি লোকেদের অনন্তকালের জন্য যাতনাও দিতে পারেন, এই ধারণাকে মেনে নেওয়া যুক্তিসংগত বলে মনে হয় না। . . . মাত্র কয়েক বছরের ভুলের জন্য, তাকে শুধরাবার কোন সুযোগ না দিয়েই তার আত্মাকে অনন্তকাল ধরে শাস্তি দেওয়ার কথা বিশ্বাস করা সমস্ত যুক্তির তর্কের বাইরে।”
২ নিখিলানন্দের মতো অনেক লোকেরা আজকে এই শিক্ষাকে মন থেকে মেনে নিতে পারেন না যে অনন্তকাল ধরে আত্মাকে কষ্ট পেতে হবে। একই কারণে, অন্যেরা এই ধারণাকে বুঝে উঠতে পারেন না যে নির্বাণ লাভের পর আত্মা ব্রহ্মে লীন হয়ে যায়। এমনকি খ্রীষ্টীয়জগতের বিভিন্ন বিভাগের লোকেরা যারা বাইবেলে বিশ্বাস করে বলে দাবি করেন তাদের মধ্যেও মানুষ আসলে কী আর মৃত্যুর পর তার কী হয় এই সম্বন্ধে আলাদা আলাদা ধারণা আছে। কিন্তু মানুষ আসলে কী, কীভাবে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং মৃত্যুর পর তার কী হয় এই সম্পর্কে বাইবেল কী শিক্ষা দেয়? উত্তর পাওয়ার জন্য, আমাদের বাইবেলে যে ইব্রীয় ও গ্রিক শব্দগুলোকে “প্রাণ” অথবা “প্রাণী” হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে সেগুলো পরীক্ষা করা দরকার।
বাইবেল অনুসারে প্রাণ কিংবা প্রাণী
৩. (ক) ইব্রীয় শাস্ত্রে কোন্ শব্দ প্রায়ই “প্রাণ” অথবা “প্রাণী” হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে আর এর মূল অর্থ কী? (খ) আদিপুস্তক ২:৭ পদ কীভাবে দেখায় যে “প্রাণী” শব্দটা আসলে একজন সম্পূর্ণ ব্যক্তিকে বোঝায়?
৩ ইব্রীয় শব্দ নেফিস-কে “প্রাণী” কিংবা “প্রাণ” হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে আর ইব্রীয় শাস্ত্রে এই শব্দ ৭৫৪ বার পাওয়া যায়। নেফিস শব্দের অর্থ কী? বাইবেল ও ধর্মের শব্দকোষ (ইংরাজি) বলে “সাধারণত এর অর্থ জীবিত সত্তা অর্থাৎ একজন সম্পূর্ণ ব্যক্তি।” আর এই কথা আমরা বাইবেলের সহজ সরল বর্ণনা থেকেই জানতে পারি যে মানুষকে কীভাবে সৃষ্টি করা হয়েছিল। বাইবেলের প্রথম বই আদিপুস্তক ২:৭ পদ বলে: “সদাপ্রভু ঈশ্বর মৃত্তিকার ধূলিতে আদমকে [অর্থাৎ মনুষ্যকে] নির্ম্মাণ করিলেন, এবং তাহার নাসিকায় ফুঁ দিয়া প্রাণবায়ু প্রবেশ করাইলেন; তাহাতে মনুষ্য সজীব প্রাণী হইল।” লক্ষ্য করুন যে প্রথম মানুষ এক প্রাণী “হইল।” অর্থাৎ “প্রাণী” শব্দের অর্থ একজন সম্পূর্ণ ব্যক্তি।
৪. খ্রীষ্টীয় গ্রিক শাস্ত্রে কোন্ শব্দকে “প্রাণ” অথবা “প্রাণী” হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে আর এই শব্দের মূল অর্থ কী?
৪ খ্রীষ্টীয় গ্রিক শাস্ত্রে যে শব্দকে অনেক বার “প্রাণী” অথবা “প্রাণ” হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে তা হল সাইকি। নেফিস এর মতো এই শব্দও একজন সম্পূর্ণ ব্যক্তিকে বোঝায়। এর অর্থ বোঝার জন্য নিচের পদগুলো দেখুন: “আমার প্রাণ উদ্বিগ্ন হইয়াছে।” (যোহন ১২:২৭) “সকলের [প্রত্যেক প্রাণীর ওপর] ভয় উপস্থিত হইল।” (প্রেরিত ২:৪৩) “প্রত্যেক প্রাণী প্রাধান্যপ্রাপ্ত কর্ত্তৃপক্ষদের বশীভূত হউক।” (রোমীয় ১৩:১) “ক্ষীণসাহসদিগকে [দুঃখিত প্রাণদের] সান্ত্বনা কর।” (১ থিষলনীকীয় ৫:১৪) “অল্প লোক, অর্থাৎ আটটী প্রাণ, জল দ্বারা রক্ষা পাইয়াছিল।” (১ পিতর ৩:২০) এটা স্পষ্ট যে নেফিস এর মতো সাইকি একজন সম্পূর্ণ ব্যক্তিকে বোঝায়। পণ্ডিত নিগেল টারনার বলেন, এই শব্দ “সম্পূর্ণ মানুষকে . . . সম্পূর্ণ দেহ সমেত সেই জীবনকে বোঝায় যার মধ্যে ঈশ্বর ফু [কার্যকারী শক্তি] দিয়েছিলেন। . . . এখানে একজন সম্পূর্ণ ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে।”
৫. যে ইব্রীয় ও গ্রিক শব্দগুলোকে প্রাণ ও প্রাণী অনুবাদ করা হয়েছে সেগুলো আর কাদের বোঝায়?
৫ লক্ষ্য করুন, বাইবেলে যে ইব্রীয় ও গ্রিক শব্দগুলোকে “প্রাণ” অথবা “প্রাণী” হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে তা শুধু মানুষ নয় কিন্তু পশুদেরকেও বোঝায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আদিপুস্তক ১:২০ পদ বলে যে ঈশ্বর আজ্ঞা দিয়েছিলেন: “জল নানাজাতীয় জঙ্গম প্রাণিবর্গে [ইব্রীয়, নেফিস] প্রাণিময় হউক।” আর পরের সৃষ্টি দিনে, ঈশ্বর বলেছিলেন: “ভূমি নানাজাতীয় প্রাণিবর্গ [ইব্রীয়, নেফিস] অর্থাৎ স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী গ্রাম্য পশু, সরীসৃপ ও বন্য পশু উৎপন্ন করুক; তাহাতে সেইরূপ হইল।”—আদিপুস্তক ১:২৪. গণনাপুস্তক ৩১:২৮, ২৯ পদের সঙ্গে তুলনা করুন।
৬. বাইবেলে যে শব্দকে প্রায়ই “প্রাণী” অনুবাদ করা হয়েছে সেটা আর কীভাবে ব্যবহৃত হয়?
৬ সুতরাং আমরা দেখেছি যে বাইবেলে প্রাণী শব্দ মানুষ ও পশু দুদলের জন্যই ব্যবহার করা হয়েছে আর এর সঙ্গে সঙ্গে এটা কোন এক ব্যক্তি বা পশুর জীবনকে বোঝাতেও ব্যবহার করা হয়েছে। (উপরের বাক্স দেখুন।) বাইবেল আমাদের খুবই সরল এবং স্পষ্টভাবে বলে যে মানুষ আসলে কী। বাইবেলের বর্ণনা মানুষের জটিল দর্শনবিদ্যা, ধারণা ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত। সুতরাং এই জরুরি প্রশ্নটা জিজ্ঞাসা করা দরকার হয়ে পড়ে, মৃত্যুর পর মানুষের কী হয় বলে বাইবেল বলে?
মৃতেরা কিছুই জানে না
৭, ৮. (ক) মৃতদের অবস্থা সম্বন্ধে বাইবেল কী বলে? (খ) বাইবেল কি বলে যে মৃত্যুর পর একজন ব্যক্তি অথবা প্রাণীর কোন অংশ বেঁচে থাকে?
৭ উপদেশক ৯:৫, ১০ পদে পরিষ্কারভাবে মৃতদের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে যেখানে আমরা পড়ি: “মৃতেরা কিছুই জানে না . . . পাতালে কোন কাজ, কোন পরিকল্পনা, কোন জ্ঞান কিংবা মেধা কিছুই নেই।” (মোফেট) তাই, মৃত্যু হলে অস্তিত্ব শেষ হয়ে যায়। গীতরচক লিখেছিলেন যে যখন একজন ব্যক্তি মারা যায়, “সে নিজ মৃত্তিকায় প্রতিগমন করে; সেই দিনেই তাহার সঙ্কল্প সকল নষ্ট হয়।” (গীতসংহিতা ১৪৬:৪) মৃতেরা কিছুই জানে না আর কোন কাজ করতে পারে না।
৮ ঈশ্বর যখন আদমকে দণ্ড শুনিয়েছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন: “তুমি ধূলি, এবং ধূলিতে প্রতিগমন করিবে।” (আদিপুস্তক ৩:১৯) ঈশ্বর তাকে মাটি থেকে তৈরি করার ও জীবন দেওয়ার আগে আদমের কোন অস্তিত্ব ছিল না। মারা যাওয়ার পরও সে আগের মতোই অস্তিত্বহীন হয়ে যায়। তার শাস্তি ছিল মৃত্যু—অন্য কোন জায়গায় গিয়ে থাকা নয়। তার মধ্যে কি অমর কিছু ছিল যেটা মৃত্যুর পরও বেঁচে ছিল? না, কারণ বাইবেল বলে যে একজন ব্যক্তি যখন মারা যায় সে পুরোপুরিই মারা যায়। বাইবেল শেখায় না যে প্রত্যেক প্রাণীর ভিতরে অমর কোন অংশ আছে যা মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকে। অমর আত্মায় বিশ্বাস করেন এমন লোকেদের কাছে এটা হয়ত অদ্ভুত বলে মনে হতে পারে কিন্তু সত্যি বিষয়টা হল এই যে মৃত্যুতে একজন সম্পূর্ণ প্রাণী অথবা ব্যক্তি পুরোপুরি শেষ হয়ে যায় আর তার মধ্যে কিছুই বেঁচে থাকে না।
৯. বাইবেলে রাহেলের “প্রাণবিয়োগ সময়ে” বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
৯ কিন্তু আদিপুস্তক ৩৫:১৮ পদে রাহেলের দ্বিতীয় ছেলের জন্মের সময় তার দুঃখজনক মৃত্যু সম্পর্কে যা বলা হয়েছে সে বিষয়ে কী বলা যায়? সেখানে আমরা পড়ি: “তাঁহার মৃত্যু হইল, আর প্রাণবিয়োগ সময়ে তিনি পুত্ত্রের নাম বিনোনী [আমার কষ্টের পুত্ত্র] রাখিলেন, কিন্তু তাহার পিতা তাহার নাম বিন্যামীন [দক্ষিণ হস্তের পুত্ত্র] রাখিলেন।” এই পদ কি বোঝায় যে মৃত্যুর সময় রাহেলের মধ্যে থেকে কিছু বেরিয়ে গিয়েছিল? কখনই না। মনে করে দেখুন যে ‘প্রাণ’ শব্দ একজন ব্যক্তির জীবনকেও বোঝায়। তাই এক্ষেত্রে, রাহেলের ‘প্রাণ’ তার “জীবন”-কে বুঝিয়েছে। সেজন্য অন্যান্য বাইবেলগুলোতে এই পদটাকে “তার জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছিল” (নক্স), “তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন” (জেবি) এবং “তার জীবন তার কাছ থেকে চলে যাচ্ছিল” (বাইবেল ইন বেসিক ইংলিশ) বলে অনুবাদ করা হয়েছে। এমন কোন কথা বলা হয়নি যাতে মনে হয় যে রাহেলের ভিতর থেকে কোন অশরীরি ছায়ার মতো অংশ বেরিয়ে যায়।
১০. কীভাবে বিধবার পুনরুত্থিত ছেলের “প্রাণ” ‘তাহার মধ্যে ফিরিয়া আসিল’?
১০ এক বিধবার ছেলের পুনরুত্থানের সময়ও এইরকমই হয়েছিল। এর বিবরণ আমরা ১ রাজাবলি ১৭ অধ্যায়ে পাই। ২২ পদে আমরা পড়ি যে এলিয় বালকের জন্য প্রার্থনা করলে: “সদাপ্রভু এলিয়ের রবে কর্ণপাত করিলেন, তাহাতে বালকটীর প্রাণ তাহার মধ্যে ফিরিয়া আসিল, সে পুনর্জীবিত হইল।” এখানেও “প্রাণ” শব্দের অর্থ “জীবন।” এজন্য নিউ আমেরিকান স্ট্যান্ডার্ড বাইবেল বলে: “বালকের জীবন ফিরে এল আর সে বেঁচে উঠল।” হ্যাঁ, এটা ছিল জীবন, অশরীরি কোন অংশ নয় যা সেই ছেলের দেহে ফিরে এসেছিল। এলিয় তার মাকে যা বলেছিলেন এটা তার সেই কথার মতোই: “দেখ, তোমার পুত্ত্র [পুরো ব্যক্তি] জীবিত।”
আত্মা সম্পর্কে কী বলা যায়?
১১. বাইবেলে “আত্মা” শব্দটা কেন কোন ব্যক্তির অশরীরি অংশকে বোঝাতে পারে না যা মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকে?
১১ (ইব্রীয় শব্দ রুয়াক্ আর গ্রিক শব্দ নিউমা)-কে বাইবেলে কোন কোন সময় আত্মা হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে, যেটার মূল অর্থ “নিঃশ্বাস” আর বাইবেলে অনেক জায়গায় এগুলোকে শ্বাস অথবা নিঃশ্বাস বলে অনুবাদ করা হয়েছে। তাই গীতসংহিতা ১৪৬:৪ পদের বেশিরভাগ অনুবাদ বলে যে কোন ব্যক্তি মারা গেলে “তাহার শ্বাস নির্গত হয়, সে নিজ মৃত্তিকায় প্রতিগমন করে।” এর মানে নয় যে “আত্মা নির্গত হয়” যা দেহের এক অমর সচেতন অংশ ও যা দেহকে ছেড়ে অন্য এক অদৃশ্য জগতে চলে যায়। এটা হতে পারে না কারণ গীতরচক পরে বলেন: “সেই দিনেই তাহার সঙ্কল্প সকল নষ্ট হয়” (“তার সমস্ত চিন্তা শেষ হয়ে যায়,” দ্যা নিউ ইংলিশ বাইবেল)।
১২. যে ইব্রীয় ও গ্রিক শব্দগুলোকে বাইবেলে “শ্বাস” অথবা “আত্মা” হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে সেগুলো কী বোঝায়?
১২ কিন্তু এই ইব্রীয় ও গ্রিক শব্দগুলোকে সবসময়ই শ্বাস হিসেবে অনুবাদ করা হয়নি কারণ তা কেবল শ্বাস নেওয়ার চেয়েও আরও বেশি কিছু বোঝায়। যেমন, জলপ্লাবনের সময় মানুষ ও পশুদের জীবন ধ্বংসের বিষয় বর্ণনা করতে গিয়ে আদিপুস্তক ৭:২২ পদ বলে: “স্থলচর যত প্রাণীর নাসিকাতে প্রাণবায়ুর সঞ্চার [অর্থাৎ আত্মা; ইব্রীয় রুয়াক্] ছিল, সকলে মরিল।” তাই ইব্রীয় শব্দ, রুয়াক্কে মাঝে মাঝে “আত্মা” অনুবাদ করা হয়েছে আর বাইবেলে এটাকে জীবনী-শক্তি বোঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে যা মানুষ ও পশু সমস্ত জীবিত প্রাণীদের মধ্যে আছে আর যা শ্বাস নেওয়ার মাধ্যমে চালু থাকে।
১৩. বাইবেল যেমন বলে একজন ব্যক্তি মারা গেলে আত্মা ঈশ্বরের কাছে ফিরে যায় এর অর্থ আসলে কী?
১৩ কিন্তু উপদেশক ১২:৭ পদের মানে কী যেখানে বলা আছে যে কেউ মারা গেলে “আত্মা যাঁহার দান, সেই ঈশ্বরের কাছে প্রতিগমন করিবে”? এর মানে কি এই যে কোন আত্মা শরীর থেকে বেরিয়ে অন্তরীক্ষে ঈশ্বরের কাছে যায়? না, কখনই তা নয়। কিন্তু আমরা যেমন দেখেছি বাইবেলে আত্মা মানে জীবনী-শক্তি, তাই এটার ‘ঈশ্বরের কাছে প্রতিগমন করার’ মানে হল, ওই মৃত ব্যক্তির জন্য ভবিষ্যতে জীবন পাওয়ার আশা এখন পুরোপুরি ঈশ্বরের ওপর নির্ভর করে। একমাত্র ঈশ্বরই কোন ব্যক্তিকে আত্মা, অর্থাৎ জীবনী-শক্তি দিতে পারেন যাতে করে সেই ব্যক্তি আবার জীবন ফিরে পাবেন। (গীতসংহিতা ১০৪:৩০) কিন্তু ঈশ্বর কী তা করতে চান?
“সে উঠিবে”
১৪. তাদের ভাইকে হারানোর পর লাসারের বোনদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য যীশু কী বলেছিলেন ও কী করেছিলেন?
১৪ যিরূশালেম থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার পূর্ব দিকে বৈথনিয়ার ছোট্ট একটা গ্রামে মরিয়ম ও মার্থা তাদের ভাই লাসারের অকাল মৃত্যুতে শোক করছিলেন। যীশুও খুবই দুঃখিত হন কারণ তিনি লাসার ও তার বোনদেরকে ভালবাসতেন। যীশু লাসারের বোনদেরকে কীভাবে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন? কিছু বানানো গল্প বলে নয় বরং তাদেরকে সত্যি কথা বলে। যীশু শুধু বলেছিলেন: “তোমার ভাই আবার উঠিবে।” তারপর যীশু কবরের কাছে যান আর লাসারকে পুনরুত্থিত করেন—চারদিন ধরে মৃত একজন ব্যক্তিকে জীবিত করেন!—যোহন ১১:১৮-২৩, ৩৮-৪৪.
১৫. যীশু যা বলেছিলেন ও করেছিলেন সেই বিষয়কে মার্থা কীভাবে দেখেছিলেন?
১৫ লাসার “আবার উঠিবে,” যীশুর এই কথা শুনে মার্থা কি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন? না, তিনি অবাক হননি কারণ তিনি উত্তর দিয়েছিলেন: “আমি জানি, শেষ দিনে পুনরুত্থানে সে উঠিবে।” তিনি আগে থেকেই পুনরুত্থানের আশায় বিশ্বাস করতেন। এরপর যীশু তাকে বলেন: “আমিই পুনরুত্থান ও জীবন; যে আমাতে বিশ্বাস করে, সে মরিলেও জীবিত থাকিবে।” (যোহন ১১:২৩-২৫) লাসারকে জীবিত করায় মার্থার বিশ্বাস মজবুত হয়েছিল আর সেইসঙ্গে অনেক অন্য লোকেরাও বিশ্বাস করেছিল। (যোহন ১১:৪৫) কিন্তু “পুনরুত্থান” কথাটার অর্থ আসলে কী?
১৬. “পুনরুত্থান” শব্দের মানে কী?
১৬ যে গ্রিক শব্দটাকে “পুনরুত্থান” হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে তা হল অ্যানাসটাসিস, যার সত্যিকারের অর্থ “আবার উঠে দাঁড়ানো।” ইব্রীয় অনুবাদকেরা গ্রিক শব্দ অ্যানাসটাসিস-কে এমনভাবে অনুবাদ করেছেন যেটার অর্থ “মৃতদের পুনরুত্থান” (ইব্রীয়, টেকিয়াথ হামেদিম)।a তাই পুনরুত্থানের মানে মৃত ব্যক্তিকে নির্জীব অবস্থা থেকে আবার জীবিত করাকে বোঝায়—ব্যক্তির জীবনকে আবার সক্রিয় করা।
১৭. (ক) মৃত ব্যক্তিদের পুনরুত্থিত করা কেন যিহোবা ঈশ্বর ও যীশু খ্রীষ্টের জন্য কোন কঠিন কাজ নয়? (খ) কবরে যারা আছেন তাদের জন্য যীশু কী প্রতিজ্ঞা করেছিলেন?
১৭ অশেষ প্রজ্ঞা ও সিদ্ধ স্মরণশক্তি থাকায় যিহোবা ঈশ্বর সহজেই একজন ব্যক্তিকে পুনরুত্থিত করতে পারেন। কোন মৃত ব্যক্তির জীবনকে মনে করা তাঁর জন্য একেবারেই কঠিন নয়। তাদের ব্যক্তিত্ব কেমন ছিল, তারা কী কী করেছিলেন আর তাদের অন্যান্য সমস্ত বিষয়। (ইয়োব ১২:১৩. যিশাইয় ৪০:২৬ পদের সঙ্গে তুলনা করুন।) এছাড়াও, যেমন লাসারের ঘটনা থেকে জানা যায় যে যীশু খ্রীষ্ট মৃতদের শুধু পুনরুত্থিতই করতে চান না, তিনি তা করতেও পারেন। (লূক ৭:১১-১৭ এবং ৮:৪০-৫৬ পদগুলোর সঙ্গে তুলনা করুন।) যীশু খ্রীষ্ট বলেছিলেন: “এমন সময় আসিতেছে, যখন কবরস্থ সকলে তাঁহার [যীশুর] রব শুনিবে।” (বাঁকা অক্ষরে মুদ্রণ আমাদের।) (যোহন ৫:২৮, ২৯) হ্যাঁ, যীশু খ্রীষ্ট প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে যিহোবার স্মরণে আছে এমন সব লোকেরা পুনরুত্থিত হবেন। তাই বোঝা যায় যে বাইবেল বলে মৃত্যুতে কোন অমর অংশ শরীর থেকে বেরিয়ে যায় না আর মৃত অবস্থা থেকে বাঁচার একমাত্র পথ হল পুনরুত্থান। কিন্তু পৃথিবীতে কোটি কোটি লোক বেঁচে ছিলেন ও মারাও গেছেন। তাদের মধ্যে কারা ঈশ্বরের স্মরণে আছেন এবং পুনরুত্থানের জন্য অপেক্ষা করছেন?
১৮. কারা কারা পুনরুত্থিত হবেন?
১৮ যিহোবার দাস হিসেবে যারা এক ধার্মিক জীবনযাপন করেছেন তারা পুনরুত্থিত হবেন। কিন্তু কোটি কোটি এমন লোকেরা আছেন যারা এটা প্রমাণ করার সুযোগই পাননি যে তারা ঈশ্বরের ধার্মিক মান মেনে চলতে চান কি না। তারা হয় যিহোবার চাহিদাগুলো সম্বন্ধে জানতেন না কিংবা জীবনে পরিবর্তন আনার জন্য যথেষ্ট সময় পাননি। এই সব লোকেরা ঈশ্বরের স্মরণে আছেন আর তাদের আবার ওঠানো হবে কারণ বাইবেল প্রতিজ্ঞা করে: “ধার্ম্মিক অধার্ম্মিক উভয় প্রকার লোকের পুনরুত্থান হইবে।”—প্রেরিত ২৪:১৫.
১৯. (ক) পুনরুত্থান সম্পর্কে প্রেরিত যোহন কোন্ দর্শন দেখেছিলেন? (খ) কাদের “অগ্নিহ্রদে নিক্ষিপ্ত” করা হবে আর এই কথার মানে কী?
১৯ প্রেরিত যোহন পুনরুত্থিত ব্যক্তিদের এক রোমাঞ্চকর দর্শন দেখেছিলেন যেখানে তারা ঈশ্বরের সিংহাসনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এই দর্শনের বিষয়ে লিখতে গিয়ে তিনি বলেন: “সমুদ্র আপনার মধ্যবর্ত্তী মৃতগণকে সমর্পণ করিল, এবং মৃত্যু ও পাতাল আপনাদের মধ্যবর্ত্তী মৃতগণকে সমর্পণ করিল, এবং তাহারা প্রত্যেকে আপন আপন কার্য্যানুসারে বিচারিত হইল। পরে মৃত্যু ও পাতাল অগ্নিহ্রদে নিক্ষিপ্ত হইল; তাহাই, অর্থাৎ সেই অগ্নিহ্রদ, দ্বিতীয় মৃত্যু।” (প্রকাশিত বাক্য ২০:১২-১৪) একটু ভেবে দেখুন যে এই কথার অর্থ কী! ঈশ্বরের স্মরণে আছেন এমন সব মৃত লোকেরা হেডিজ অথবা শিওল অর্থাৎ মানবজাতির সাধারণ কবর থেকে বের হয়ে আসবেন। (গীতসংহিতা ১৬:১০; প্রেরিত ২:৩১) এরপর “মৃত্যু ও পাতাল”-কে “অগ্নিহ্রদে” নিক্ষেপ করা হবে যার মানে চিরতরে ধ্বংস। সেই সময়ের পর থেকে আর কখনও কবর চোখে পড়বে না।
এক অদ্বিতীয় আশা!
২০. কোটি কোটি মৃত ব্যক্তিরা কেমন পরিবেশে পুনরুত্থিত হবেন?
২০ কোটি কোটি ব্যক্তিদের যখন পুনরুত্থান হবে তাদেরকে এক শূন্য পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হবে না। (যিশাইয় ৪৫:১৮) তাদের চারপাশে এক সুন্দর পরিবেশ থাকবে আর তারা দেখতে পাবেন তাদের জন্য থাকার সুন্দর ঘর, কাপড় ও প্রচুর খাবার রয়েছে। (গীতসংহিতা ৬৭:৬; ৭২:১৬; যিশাইয় ৬৫:২১, ২২) তাদের জন্য এই সমস্তকিছু কারা করবেন? স্পষ্টতই, তারা যারা পুনরুত্থান শুরু হওয়ার আগেই জীবিত অবস্থায় পার হয়ে নতুন জগতে পৌঁছাবেন। কিন্তু তারা কারা?
২১, ২২. “শেষ কালে” যারা বাস করছেন তাদের সামনে কোন্ অদ্বিতীয় আশা অপেক্ষা করছে?
২১ বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণীর পরিপূর্ণতা দেখায় যে আমরা এই বিধিব্যবস্থার “শেষ কালে” বাস করছি।b (২ তীমথিয় ৩:১) এখন খুব শীঘ্রিই যিহোবা পৃথিবীর বিষয়গুলোতে হস্তক্ষেপ করবেন আর পৃথিবী থেকে দুষ্টতাকে একেবারে মুছে দেবেন। (গীতসংহিতা ৩৭:১০, ১১; হিতোপদেশ ২:২১, ২২) সেই সময় তাদের কী হবে যারা বিশ্বস্ততার সঙ্গে ঈশ্বরের সেবা করে চলেছেন?
২২ যিহোবা দুষ্টদের সঙ্গে ধার্মিকদের ধ্বংস করবেন না। (গীতসংহিতা ১৪৫:২০) তিনি কখনও এমন করেননি আর তিনি তা তখনও করবেন না যখন তিনি এই পৃথিবীর সমস্ত দুষ্টতাকে শেষ করবেন। (আদিপুস্তক ১৮:২২, ২৩, ২৬ পদের সঙ্গে তুলনা করুন।) বাস্তবিকই, বাইবেলের শেষ বই “প্রত্যেক জাতির ও বংশের ও প্রজাবৃন্দের ও ভাষার বিস্তর লোক, তাহা গণনা করিতে সমর্থ কেহ ছিল না,” এমন লোকেদের কথা বলে যারা “মহাক্লেশের মধ্য হইতে আসিয়াছে।” (প্রকাশিত বাক্য ৭:৯-১৪) হ্যাঁ, এক বিরাট জনতা মহাক্লেশ থেকে রক্ষা পাবেন, যখন সমস্ত দুষ্ট জগৎ ধ্বংস হয়ে যাবে আর এই বিরাট জনতা ঈশ্বরের নতুন জগতে প্রবেশ করবে। ঈশ্বর মানবজাতিকে পাপ ও মৃত্যু থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য যে ব্যবস্থা করেছেন, এই বিশ্বস্ত লোকেরা সেই ব্যবস্থা থেকে পুরোপুরি উপকার লাভ করতে পারবে। (প্রকাশিত বাক্য ২২:১, ২) এভাবে “বিস্তর লোক” এর কখনও মৃত্যুর স্বাদ পাওয়ার দরকার হবে না। এক অদ্বিতীয় আশা!
মৃত্যু ছাড়া জীবন
২৩, ২৪. পরমদেশ পৃথিবীতে না মরে চিরকাল জীবন উপভোগ করার জন্য আপনাকে কী করতে হবে?
২৩ এই বিস্ময়কর আশাকে কি আমরা বাস্তব মনে করতে পারি? অবশ্যই! যীশু খ্রীষ্ট নিজে বলেছিলেন যে এমন সময় আসবে যখন লোকেরা না মরে চিরকাল বেঁচে থাকবে। যীশু তাঁর বন্ধু লাসারকে পুনরুত্থিত করার আগের মুহূর্তে মার্থাকে বলেছিলেন: “যে কেহ জীবিত আছে, এবং আমাতে বিশ্বাস করে, সে কখনও মরিবে না।”—যোহন ১১:২৬.
২৪ আপনি কি পরমদেশ পৃথিবীতে চিরকাল বাস করতে চান? আপনি কি আপনার প্রিয়জনদের আবার দেখতে চান? প্রেরিত যোহন বলেছিলেন, “জগৎ ও তাহার অভিলাষ বহিয়া যাইতেছে; কিন্তু যে ব্যক্তি ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন করে, সে অনন্তকালস্থায়ী।” (১ যোহন ২:১৭) তাই এখনই সেই সময় যখন আপনি শিখতে পারেন যে ঈশ্বরের ইচ্ছা কী আর এখনই আপনি তাঁর ইচ্ছা মতো চলার জন্য মনস্থির করতে পারেন। তাহলে আপনিও ঈশ্বরের লক্ষ লক্ষ লোকেরা যারা ইতিমধ্যেই ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন করছেন তাদের সঙ্গে পরমদেশ পৃথিবীতে বাস করতে পারবেন।
[পাদটীকাগুলো]
a ইব্রীয় শাস্ত্রে “পুনরুত্থান” শব্দটা দেখা না গেলেও ইয়োব ১৪:১৩ পদ, দানিয়েল ১২:১৩ পদ এবং হোশেয় ১৩:১৪ পদে পুনরুত্থানের আশার কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।
b ওয়াচটাওয়ার বাইবেল অ্যান্ড ট্র্যাক্ট সোসাইটি দ্বারা প্রকাশিত জ্ঞান যা অনন্ত জীবনে পরিচালিত করে বইয়ের ৯৮-১০৭ পৃষ্ঠা দেখুন।
আপনি কি মনে করতে পারেন?
◻ যে মূল শব্দগুলোকে “প্রাণ” অথবা “প্রাণী” হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে সেগুলোর অর্থ কী?
◻ মানুষ মারা গেলে কী হয়?
◻ বাইবেল অনুসারে মৃত অবস্থা থেকে বাঁচার একমাত্র পথ কী?
◻ আজকে বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের জন্য কোন্ অদ্বিতীয় আশা অপেক্ষা করছে?
[১৫ পৃষ্ঠার বাক্স]
প্রাণীর “প্রাণ”
অনেক সময় “প্রাণ” শব্দ জীবনকে বোঝায় যা একজন ব্যক্তি বা পশুর রয়েছে। তাই বাইবেলে যখন ইব্রীয় শব্দ নেফিস ও গ্রিক শব্দ সাইকি-র জন্য প্রাণ বা প্রাণী ব্যবহার করা হয়েছে তখন তা বাইবেল লেখকেদের মনে যে অর্থ ছিল তাকে বদলে দেয় না। যখন ইব্রীয় শব্দ নেফিস ও গ্রিক শব্দ সাইকি একজন সম্পূর্ণ ব্যক্তিকে বোঝায় তখন সেটা প্রাণী হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে, অর্থাৎ সেই ব্যক্তি নিজে এক প্রাণী। কিন্তু যখন এই শব্দগুলোর ব্যবহার কোন জীবিত ব্যক্তির মধ্যে থাকা জীবনকে বোঝায় তখন তা প্রাণ হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, ঈশ্বর মোশিকে বলেছিলেন: “যে লোকেরা তোমার প্রাণনাশের চেষ্টায় ছিল, তাহারা সকলে মরিয়া গিয়াছে।” এটা পরিষ্কার যে মোশির শত্রুরা তার জীবন নেওয়ার চেষ্টা করছিল। (যাত্রাপুস্তক ৪:১৯. যিহোশূয়ের পুস্তক ৯:২৪ ও হিতোপদেশ ১২:১০ পদগুলোর সঙ্গে তুলনা করুন।) একইভাবে যীশুও একই শব্দ ব্যবহার করেছিলেন যখন তিনি বলেছিলেন: “মনুষ্যপুত্ত্র . . . অনেকের পরিবর্ত্তে আপন প্রাণ মুক্তির মূল্যরূপে দিতে আসিয়াছেন।” (মথি ২০:২৮. মথি ১০:২৮ পদের সঙ্গে তুলনা করুন।) প্রতিটা ক্ষেত্রেই “প্রাণ” শব্দের অর্থ “জীবন।”
[১৫ পৃষ্ঠার চিত্র]
এরা সকলে প্রাণী
[সজন্যে]
হামিংবার্ড: U.S. Fish and Wildlife Service, Washington, D.C./Dean Biggins
[১৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
যীশু দেখিয়েছিলেন যে পুনরুত্থান হল মৃত অবস্থা থেকে বাঁচার একমাত্র পথ
[১৮ পৃষ্ঠার চিত্র]
“যে কেহ জীবিত আছে, এবং আমাতে বিশ্বাস করে, সে কখনও মরিবে না।”—যোহন ১১:২৬