মৃত্যুর পরে জীবন—লোকেরা কী বিশ্বাস করেন?
“মনুষ্য মরিয়া কি পুনর্জীবিত হইবে?”—ইয়োব ১৪:১৪.
১, ২. প্রিয়জনের মৃত্যু হলে অনেকে কীভাবে সান্ত্বনা খোঁজেন?
সতেরো বছরের এক ছেলের মৃতদেহ একটা খোলা কফিনে রাখা আছে। নিউ ইয়র্ক শহরের এই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় পরিবারের লোকেরা ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা জমা হয়েছেন। চারিদিক নিস্তব্ধতায় ছেয়ে আছে আর তাকে শেষবারের মতো দেখার জন্য আত্মীয়রা মৃতদেহের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। ছেলেটা ক্যানসারে ভুগে মারা গেছে। শোকে ভেঙে পড়া মা কাঁদতে কাঁদতে বার বার শুধু বলছেন: “টমি এখন সবচেয়ে সুখী। ঈশ্বর টমিকে তাঁর কাছে স্বর্গে নিয়ে গেছেন।” টমির মা এইরকমই বিশ্বাস করতেন কারণ তার ধর্ম তাকে এটাই শিখিয়েছে।
২ সেখান থেকে প্রায় ১১,০০০ কিলোমিটার দূরে, ভারতের জামনগরে বাবার চিতায় আগুন দেওয়ার জন্য তিন ছেলের মধ্যে বড় জন এগিয়ে আসেন। জলন্ত আগুনের শব্দের মধ্যে দিয়ে এক ব্রাহ্মণের সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণ শোনা যায়: “মৃত্যুহীন অমর আত্মা যেন পরমব্রহ্মে লীন হয়ে যায়।”
৩. যুগ যুগ ধরে কোন্ প্রশ্নগুলো লোকেদের ভাবিয়েছে?
৩ আমরা সবাই জানি যে মৃত্যু কী। (রোমীয় ৫:১২) তাই আমাদের জন্য এটা ভাবা স্বাভাবিক যে মৃত্যুতেই সবকিছু শেষ হয়ে যায় কি না। উদ্ভিদের জীবন চক্র সম্বন্ধে কথা বলতে গিয়ে যিহোবা ঈশ্বরের প্রাচীনকালের একজন বিশ্বস্ত দাস, ইয়োব বলেছিলেন: “বৃক্ষের আশা আছে, ছিন্ন হইলে তাহা পুনর্ব্বার পল্লবিত হইবে, তাহার কোমল শাখার অভাব হইবে না।” তাহলে, মানুষের সম্বন্ধে কী বলা যায়? ইয়োব জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “মনুষ্য মরিয়া কি পুনর্জীবিত হইবে?” (ইয়োব ১৪:৭, ১৪) যুগ যুগ ধরে প্রতিটা সমাজের লোকেদের এই প্রশ্নগুলো ভাবিয়েছে: মৃত্যুর পরে কি জীবন আছে? যদি থাকেই, তাহলে তা কীধরনের জীবন? লোকেরা কী বিশ্বাস করেন? আর কেনই বা তা করেন?
বিষয় একটাই উত্তর কিন্তু অনেক
৪. মৃত্যুর পরে জীবন সম্বন্ধে বিভিন্ন ধর্মের লোকেরা কী বিশ্বাস করেন?
৪ অনেক খ্রীষ্টানেরা বিশ্বাস করেন যে মৃত্যুর পর মানুষ হয় স্বর্গে অথবা নরকে যান। অন্যদিকে হিন্দুরা পুনর্জন্মে বিশ্বাস করেন। মুসলমানরা বিশ্বাস করেন, মৃত্যুর পর কেয়ামতের দিন আসবে আর তখন আল্লাহ্ প্রত্যেক ব্যক্তির কর্ম পরীক্ষা করার পর হয় তাদের জান্নাতে (স্বর্গ) অথবা দোজখে (নরক) পাঠাবেন। আবার কিছু দেশে, মৃতদের অবস্থা সম্বন্ধে বিশ্বাস, সেখানকার পরম্পরাগত রীতি ও খ্রীষ্টধর্মের এক অদ্ভুত মিশ্রণ। যেমন, শ্রীলংকায় বৌদ্ধ ও ক্যাথলিক দুদলই তাদের ঘরে কেউ মারা গেলে সব দরজা জানালা খুলে দেন আর বাক্সটা এমনভাবে রাখেন যেন মৃতদেহের পায়ের দিকটা দরজার দিকে মুখ করা থাকে। তারা মনে করেন যে এইরকম করলে মৃতব্যক্তির আত্মা সহজে বেরিয়ে যেতে পারবে। পশ্চিম আফ্রিকার অনেক ক্যাথলিক ও প্রটেস্টান্টদের রীতি রয়েছে যে কেউ মারা গেলে তারা ঘরের সব আয়নাগুলো ঢেকে দেন, যাতে কেউ ওই মৃত ব্যক্তির আত্মা আয়নায় দেখতে না পান। এরপর ৪০ দিন বাদে, পরিবারের সবাই এবং বন্ধুবান্ধবেরা মিলে আত্মার স্বর্গে যাওয়ার আনন্দোৎসব করেন।
৫. বেশিরভাগ ধর্ম কোন্ একটা বিষয়ে পুরোপুরি একমত?
৫ এইরকম আলাদা আলাদা বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও, মনে হয় যে বেশিরভাগ ধর্মই অন্তত একটা বিষয়ে পুরোপুরি একমত। তারা বিশ্বাস করেন যে ব্যক্তির ভিতরে অবশ্যই অমর কিছু রয়েছে যা দেহের মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকে। খ্রীষ্টীয়জগতের প্রায় শত শত সম্প্রদায় ও ভাগগুলো বিশ্বাস করে যে মানুষের ভিতরে অমর কিছু রয়েছে। এটা যিহূদী ধর্মেরও একটা বিশেষ মতবাদ। এটা হিন্দু ধর্মের পুনর্জন্মের শিক্ষার ভিত্তি। মুসলমানরা বিশ্বাস করেন যে দেহ মারা যাওয়ার পরও রুহ্ বেঁচে থাকে। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা, আফ্রিকার সর্বপ্রাণবাদীরা, শিন্টো ধর্মের লোকেরা ও এমনকি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরাও কোন না কোন ভাবে এই একই বিষয়কে শিখিয়ে থাকে।
৬. মানুষের এক অমর আত্মা আছে, এই ধারণাকে কিছু পণ্ডিত ব্যক্তিরা কীভাবে দেখে থাকেন?
৬ অন্যদিকে, এমন লোকেরাও আছেন যারা বিশ্বাস করেন যে মৃত্যুতে জীবন শেষ হয়ে যায়। ছায়ার মতো কোন জিনিস দেহ থেকে আলাদা হয়ে বেঁচে থাকে আর সবকিছু জানতে ও বুঝতে পারে, এমন ধারণা তাদের কাছে একেবারে অযৌক্তিক। অন্যেরা যারা ব্যক্তির অমরত্বে বিশ্বাস করতেন না তাদের মধ্যে আছেন, প্রাচীন দার্শনিক অ্যারিস্টটল ও ইপিকুরাস, ডাক্তার হিপ্পোক্রেটস্, স্কটিশ দার্শনিক ডেভিড হিউম, আরবীয় পণ্ডিত অ্যাভেরোস আর স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহওরলাল নেহেরু।
৭. আত্মার শিক্ষার ব্যাপারে কোন্ জরুরি প্রশ্নগুলো নিয়ে এখন চিন্তা করা উচিত?
৭ এইরকম নানা ধারণা ও বিশ্বাস দেখে আমাদের জিজ্ঞাসা করা উচিত: আমাদের ভেতরে কি আসলেই কোন অমর আত্মা আছে? যদি নাই থাকে, তাহলে এমন একটা মিথ্যা শিক্ষা কীভাবে আজ পৃথিবী জুড়ে ধর্মগুলোর মূল শিক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে? এই শিক্ষা কোথা থেকে এসেছে? এই প্রশ্নগুলোর সত্য ও সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া আমাদের জন্য খুবই দরকার কারণ আমাদের ভবিষ্যৎ এর ওপর নির্ভর করে। (১ করিন্থীয় ১৫:১৯) কিন্তু, এর আগে আসুন আমরা দেখি যে এই শিক্ষার শুরু কোথা থেকে হয়েছে।
এই মতবাদের উৎপত্তি
৮. অমর আত্মার ধারণাকে ছড়িয়ে দেওয়ায় সক্রেটিস ও প্লেটোর কতখানি হাত ছিল?
৮ মনে করা হয় যে সা.কা.পূ. পঞ্চম শতাব্দীর গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস ও প্লেটোই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যারা এই শিক্ষাকে ছড়িয়েছিলেন যে মানুষের মধ্যে এক অমর আত্মা আছে। কিন্তু তারা এই শিক্ষার শুরু করেননি। বরং তারা এই শিক্ষাকে সংশোধন করে এটাকে দর্শনবিদ্যার রূপ দিয়েছিলেন আর এর ফলে এই শিক্ষা তাদের সময়ে ও পরেও শিক্ষিত শ্রেণীর কাছে খুবই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বিষয়টা হচ্ছে তাদের আগেও প্রাচীন পারস্যের অগ্নিউপাসকেরা ও মিশরীয়রা বিশ্বাস করত যে মানুষের মধ্যে অমর কিছু আছে। তাই প্রশ্ন থেকে যায়, এই শিক্ষার উৎপত্তি তাহলে কোথা থেকে হয়েছে?
৯. মিশর, পারস্য ও গ্রিসের প্রাচীন সংস্কৃতির ওপর কোন্ সভ্যতার প্রভাব পড়েছিল?
৯ বাবিলনিয়া এবং অশূরিয়ার ধর্ম (ইংরাজি) বইটা বলে, “প্রাচীন মিশর, পারস্য এবং গ্রিসের ওপর বাবিলনীয় ধর্মের প্রভাব ছিল।” মিশরের ধর্মীয় বিশ্বাস সম্বন্ধে বইটা আরও বলে: “এল-আমারনা ফলকগুলো মিশর ও বাবিলনিয়ার মধ্যে প্রাচীন সম্পর্কের বিষয়ে বলে, যার থেকে জানা যায় যে বাবিলনীয় ধর্মমত ও রীতিনীতি মিশরের ধর্মের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল।”a আর পারসিক ও গ্রিক সংস্কৃতির জন্যও অনেকটা এই কথাই বলা যায়।
১০. মৃত্যুর পরে জীবন সম্পর্কে বাবিলনীয়রা কী মানতেন?
১০ কিন্তু প্রাচীন বাবিলনীয়রা কি বিশ্বাস করতেন যে মানুষের ভিতরে অমর কিছু আছে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মরিস জ্যাস্ট্রো জুনিয়র লিখেছিলেন: “[বাবিলনের] সাধারণ লোকেরা বা ধর্মীয় নেতারা কেউই বিশ্বাস করতেন না যে একবার জন্ম নেওয়ার পর জীবন পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। [তাদের দৃষ্টিতে] মৃত্যু ছিল অন্য একটা জীবনে যাওয়ার পথ আর [এই জীবনে] যদি কেউ অমর না হতেন তবে তা আরও বেশি নিশ্চিত করত যে মৃত্যু তাদের জন্য অন্য এক জীবন পাওয়ার রাস্তা খুলে দেয়।” হ্যাঁ, বাবিলনীয়রা বিশ্বাস করতেন যে মৃত্যুর পরেও কোন না কোনভাবে কিংবা কোন আকার নিয়ে জীবন বেঁচে থাকে। আর মৃত ব্যক্তির সঙ্গে তার ব্যবহারের জন্য কিছু জিনিস কবরে দিয়ে তারা তাদের এই বিশ্বাস দেখাতেন।
১১, ১২. মানুষের ভিতরে অমর আত্মা আছে এই শিক্ষা জলপ্লাবনের পর কোথায় শুরু হয়েছিল?
১১ তাহলে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকে না যে অমর আত্মার শিক্ষার জন্মস্থান প্রাচীন বাবিলন। এটা কি বিশেষ কিছু বোঝায়? বাইবেল অনুসারে, বাবিল বা বাবিলন শহর নোহের প্রপৌত্র নিম্রোদ বানিয়েছিল। নোহের জলপ্লাবনের পর পৃথিবীর সব লোক একই ভাষায় কথা বলত ও তাদের একটা মাত্র ধর্ম ছিল। নিম্রোদ একাই “সদাপ্রভুর সাক্ষাতে পরাক্রান্ত ব্যাধ” ছিল না কিন্তু সে ও তার অনুসারীরা “আপনাদের নাম বিখ্যাত” করতে চেয়েছিল। এইজন্য নিম্রোদ একটা শহর ও দুর্গ তৈরি করে আরেকটা নতুন ধর্মের সূত্রপাত করেছিল।—আদিপুস্তক ১০:১, ৬, ৮-১০; ১১:১-৪.
১২ মনে করা হয় যে নিম্রোদের মৃত্যু ভয়াবহভাবে হয়েছিল। নিম্রোদ বাবিলন শহরের প্রতিষ্ঠাতা, নির্মাতা আর প্রথম রাজাও ছিল। এইজন্য তার মৃত্যুর পর বাবিলের লোকেরা তাকে উচ্চ সম্মান দিয়েছিল। আবার এও মনে করা হয় যে বাবিলনীয় দেবতা মার্দাক (মরোদক) বাবিলনের প্রতিষ্ঠা করেছিল আর বাবিলনের অনেক রাজার নাম তার নাম অনুসারে রাখা হয়েছিল। এই কারণে কিছু পণ্ডিতেরা বলেন যে মার্দাকই নিম্রোদ ছিল যাকে লোকেরা দেবতা বলে পুজো করত। (২ রাজাবলি ২৫:২৭; যিশাইয় ৩৯:১; যিরমিয় ৫০:২) যদি তাই হয়, তবে নিম্রোদের সময়েই এই ধারণা বেড়ে উঠতে শুরু করে যে একজন ব্যক্তির মধ্যে অমর কিছু আছে যা মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকে। যাইহোক, ইতিহাস বলে যে অমর আত্মার শিক্ষার শুরু জলপ্লাবনের পর বাবিল বা বাবিলন শহরে হয়েছিল।
১৩. অমর আত্মার শিক্ষা কীভাবে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল আর এর ফল কী হয়েছিল?
১৩ বাইবেল বলে যে ঈশ্বর ভাষা ভেদ ঘটিয়ে বাবিলে দুর্গ নির্মাতাদের চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন। এখন একে অন্যের ভাষা বুঝতে না পারায় তারা দুর্গ বানানো ছেড়ে দেয় আর এখান থেকেই “সমস্ত ভূমণ্ডলে” ছড়িয়ে পড়ে। (আদিপুস্তক ১১:৫-৯) আমাদের মনে রাখা উচিত যে এই দুর্গ নির্মাতাদের ভাষা বদলে গেলেও, তাদের চিন্তাধারা ও ধারণাগুলো কিন্তু পাল্টায়নি। ফলে তারা যেখানেই গিয়েছিল তাদের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ধর্মীয় শিক্ষাগুলোও নিয়ে গিয়েছিল। এভাবে বাবিলনীয় ধর্মীয় শিক্ষা—যার মধ্যে অমর আত্মার শিক্ষাও আছে—সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল আর পৃথিবীর বড় বড় ধর্মগুলোর এক মূল শিক্ষা হয়ে উঠেছিল। আর এভাবে সারা পৃথিবীতে এই মিথ্যা ধর্মের এক সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে যাকে বাইবেল “মহতী বাবিল, পৃথিবীর বেশ্যাগণের ও ঘৃণাস্পদ সকলের জননী,” বলে।—প্রকাশিত বাক্য ১৭:৫.
মিথ্যা ধর্মের বিশ্ব সাম্রাজ্য প্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ে
১৪. ভারত ও এর আশেপাশের দেশগুলোতে কীভাবে বাবিলনীয় ধর্মীয় বিশ্বাসগুলো ছড়িয়ে পড়েছিল?
১৪ কয়েকজন ইতিহাসবেত্তা বলেন যে আজ থেকে ৩,৫০০ বছরেরও বেশি আগে শ্বেত বর্ণের আর্য লোকেদের বড় দল উত্তরপশ্চিম দিক থেকে সিন্ধু উপত্যকায় এসে বসবাস শুরু করে, এখন যেটা পাকিস্তান ও ভারতে অবস্থিত। সেখান থেকে তারা গঙ্গার সমভূমি ও ভারতের ওপারে ছড়িয়ে পড়ে। কিছু পণ্ডিত ব্যক্তি বলেন যে এখানে এসে বাস করতে থাকা এই লোকেদের ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তি ছিল প্রাচীন ইরান ও বাবিলনীয় ধর্মশিক্ষা। আর পরে এই ধর্মীয় শিক্ষাই হিন্দুধর্মের মূল শিক্ষা হয়ে ওঠে।
১৫. অমর আত্মার ধারণা কীভাবে আজকে হিন্দু ধর্মের প্রধান শিক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে?
১৫ অমর আত্মার ধারণা থেকে ভারতে পুনর্জন্মের মতবাদ এসেছে। জগতের মন্দতা আর মানুষের দুঃখকষ্টের কারণ ও তার থেকে মুক্তির পথ খোঁজার জন্য হিন্দু মুনি ঋষিরা কর্মের শিক্ষা দিয়েছিলেন যা বলে, যে যেমন কর্ম করবে সে তেমন ফল পাবে। এই শিক্ষাকে অমর আত্মার বিশ্বাসের সঙ্গে মিশিয়ে, তারা পুনর্জন্মের শিক্ষায় পৌঁছেছিলেন। এটা শেখায় যে একজনকে তার ভাল ও খারাপ কাজের ফল পরের জন্মে ভোগ করতে হবে। ধর্মকর্ম মেনে চললে মোক্ষ লাভ করা যায় অর্থাৎ পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্তি পেয়ে পরমব্রহ্মে লীন হওয়া যায়। শত শত বছর ধরে হিন্দুধর্ম যতই ছড়িয়ে পড়েছে পুনর্জন্মের শিক্ষাও তার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে। আর এই মতবাদ আজকে হিন্দু ধর্মের প্রধান শিক্ষা হয়ে উঠেছে।
১৬. পূর্ব এশিয়ার লক্ষ লক্ষ লোকেদের ধর্মীয় ধারণা ও রীতিনীতিতে কোন্ বিশ্বাস এক মূল শিক্ষা হয়ে উঠেছে?
১৬ হিন্দু ধর্ম থেকে অন্যান্য ধর্মগুলো এসেছে যেমন, বৌদ্ধ, জৈন এবং শিখ ধর্ম। এই ধর্মগুলোও পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে। বৌদ্ধ ধর্ম যখন পূর্ব এশিয়া অর্থাৎ চিন, কোরিয়া, জাপান ও অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে, তখন সেই অঞ্চলের সংস্কৃতি ও ধর্মের ওপর তা গভীর ছাপ ফেলে। এর ফলে এমন এক মিশ্র ধর্ম তৈরি হয় যাতে বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষার সঙ্গে প্রেতাত্মাবাদ এবং পূর্বপুরুষদের উপাসনা জুড়ে দেওয়া হয়। এইরকম ধর্মগুলোর মধ্যে বড় বড় ধর্ম হল তাও, কনফুসিয়াস ও শিন্টো ধর্ম। এভাবেই, দেহের মৃত্যু হওয়ার পরও জীবন বেঁচে থাকে এই বিশ্বাস, পৃথিবীর ওই অংশগুলোর ধর্মের এক মূল শিক্ষা হয়ে উঠেছে।
যিহূদীধর্ম, খ্রীষ্টীয়জগৎ ও ইসলাম ধর্ম সম্বন্ধে কী বলা যায়?
১৭. মৃত্যুর পরে জীবন সম্পর্কে প্রাচীন যিহূদীরা কী বিশ্বাস করতেন?
১৭ খ্রীষ্টীয়জগৎ, যিহূদী ও ইসলাম ধর্মের লোকেরা মৃত্যুর পরে জীবন সম্পর্কে কী বিশ্বাস করেন? এই ধর্মগুলোর মধ্যে যিহূদীধর্ম হল সবচেয়ে পুরনো। এই ধর্ম অব্রাহামের সময় থেকে শুরু হয়েছে অর্থাৎ প্রায় ৪,০০০ বছরেরও বেশি আগে—সক্রেটিস ও প্লেটোর থেকে অনেক অনেক আগে যারা অমর আত্মার শিক্ষাকে ছড়িয়েছিলেন। প্রাচীন যিহূদীরা মৃতদের পুনরুত্থানে বিশ্বাস করতেন কিন্তু মানুষের মধ্যে অমর আত্মা থাকে এই শিক্ষায় নয়। (মথি ২২:৩১, ৩২; ইব্রীয় ১১:১৯) তাহলে, যিহূদী ধর্মে অমর আত্মার শিক্ষা কীভাবে এসেছে? ইতিহাসই এর উত্তর দেয়।
১৮, ১৯. অমর আত্মার শিক্ষা যিহূদীধর্মে কীভাবে এসেছিল?
১৮ সাধারণ কাল পূর্ব ৩৩২ সালে, গ্রিসের মহান আলেকজান্ডার যিরূশালেম সমেত পুরো মধ্যপ্রাচ্য জয় করেছিলেন। আলেকজান্ডারের উত্তরাধিকারীরা তার মৃত্যুর পর পুরো সাম্রাজ্যে গ্রিক সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করে চলেছিলেন। এই কারণে গ্রিক এবং যিহূদী এই দুই সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটেছিল। এভাবে ধীরে ধীরে যিহূদীরা গ্রিক চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন আর এমনকি তাদের কেউ কেউ দার্শনিকও হয়ে উঠেছিলেন।
১৯ প্রথম শতাব্দীর, আলেকজান্দ্রিয়ার ফিলিও এইরকমই একজন যিহূদী দার্শনিক ছিলেন। প্লেটোর প্রতি তার এতখানিই শ্রদ্ধা ছিল যে তিনি গ্রিক দর্শনের ওপর ভিত্তি করে যিহূদী ধর্মকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন আর তার পরের অনেক যিহূদী চিন্তাবিদদের জন্য তিনি পথ তৈরি করেছিলেন। যিহূদী ধর্মগুরুদের লেখা মৌখিক আইনের বই—তালমুডেও—গ্রিক চিন্তাধারার ছাপ পড়ে। এনসাইক্লোপিডিয়া জুডাইকা বলে, “তালমুডের লেখক, যিহূদী গুরুরা বিশ্বাস করতেন যে মানুষের মধ্যে আত্মা আছে যা মৃত্যুর পর বেঁচে থাকে।” পরে যিহূদীদের রহস্যময় সাহিত্য, কাবেলা পুনর্জন্মের শিক্ষাও দিতে থাকে। অতএব, অমর আত্মার শিক্ষা চুপিসারে গ্রিক দর্শনবিদ্যার মাধ্যমে যিহূদী ধর্মে ঢুকে পড়েছিল। কিন্তু, খ্রীষ্টীয়জগতে এই শিক্ষা কী করে এসেছিল?
২০, ২১. (ক) প্রথম শতাব্দীর খ্রীষ্টানেরা প্লেটো কিংবা গ্রিক দর্শনকে কোন্ চোখে দেখেছিলেন? (খ) প্লেটোর ধারণাকে কীভাবে খ্রীষ্টীয় শিক্ষার সঙ্গে মিশিয়ে ফেলা হয়েছিল?
২০ যীশু খ্রীষ্ট প্রকৃত খ্রীষ্টধর্মের সূচনা করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর একজন বিখ্যাত স্প্যানিশ পণ্ডিত যীশুর বিষয়ে লিখেছিলেন: “তিনি দেহের পুনরুত্থানে বিশ্বাস করতেন যেমন যিহূদী ধর্মে বিশ্বাস করা হতো কিন্তু তিনি [গ্রিক] প্লেটোর রীতিনীতি অনুযায়ী অমর আত্মায় বিশ্বাস করতেন না।” শেষে তিনি বলেছিলেন: “অমর আত্মা-র শিক্ষা . . . একটা ন-খ্রীষ্টীয় দার্শনিক মতবাদ।” এই অবস্থা দেখে আমরা বুঝতে পারি যে কেন প্রেরিত পৌল প্রথম শতাব্দীর খ্রীষ্টানদেরকে জোরালোভাবে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন: “দর্শনবিদ্যা ও অনর্থক প্রতারণা . . . মনুষ্যদের পরম্পরাগত শিক্ষার অনুরূপ, জগতের অক্ষরমালার অনুরূপ, খ্রীষ্টের অনুরূপ নয়।”—কলসীয় ২:৮.
২১ এই “ন-খ্রীষ্টীয় দার্শনিক মতবাদ” কখন আর কীভাবে খ্রীষ্টীয়জগতে এসেছিল? দ্যা নিউ এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা ব্যাখ্যা করে: “দ্বিতীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে যে খ্রীষ্টানদের গ্রিক দর্শনবিদ্যায় জ্ঞান ছিল, তারা তাদের মনের খোরাক পূরণ করার জন্য ও শিক্ষিত ন-খ্রীষ্টীয়দের ধর্মান্তরিত করার জন্য তাদের বিশ্বাসকে গ্রিক দর্শনের ওপর ভিত্তি করে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন। যে দর্শনবিদ্যা তাদের খুব বেশি কাজে এসেছিল তা ছিল প্লেটোর দর্শনবাদ।” এইরকম দুজন প্রাচীন দার্শনিক যারা খ্রীষ্টীয়জগতের মতবাদগুলোর ওপর খুব বেশি ছাপ ফেলেছিলেন তারা ছিলেন, আলেকজান্দ্রিয়ার অরিগেন এবং হিপ্পোর অগাস্টিন। এরা দুজনেই প্লেটোর ধারণাগুলোর দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন আর এই ধারণাগুলোকে খ্রীষ্টীয় শিক্ষায় ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য অনেক কাজ করেছিলেন।
২২. অমর আত্মা অথবা রুহ্য়ের শিক্ষা কীভাবে ইসলাম ধর্মের এক বিশেষ শিক্ষা হিসেবে থেকে যায়?
২২ যিহূদী ধর্ম ও খ্রীষ্টীয়জগতে অমর আত্মার ধারণা প্লেটোর দর্শনবাদ থেকে আসলেও, ইসলাম ধর্মে শুরু থেকেই এই ধারণাটা ছিল। মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরান শিক্ষা দেয় যে মানুষের মধ্যে আত্মা (আরবি: রুহ্) আছে যা মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকে। কোরান, আত্মা বা রুহ্য়ের দুটো পরিণতি সম্বন্ধে বলে। স্বর্গীয় (জান্নাত) বাগানে জীবন নয়তো বা অগ্নিময় নরকে (দোজখ) শাস্তিভোগ। কিন্তু এর মানে এই নয় যে আরবীয় পণ্ডিতরা ইসলামিক শিক্ষা ও গ্রিক দর্শনকে মেশানোর চেষ্টা করেননি। যদিও, আরব বিশ্বে অ্যারিস্টটলের শিক্ষা গভীর প্রভাব ফেলেছিল কিন্তু তবুও আজ পর্যন্ত মুসলমানরা অমর আত্মা বা রুহ্য়ের শিক্ষায় বিশ্বাস করে।
২৩. মৃত্যুর পরে জীবন সম্পর্কে কোন্ প্রশ্নগুলো পরের প্রবন্ধে আলোচনা করা হবে?
২৩ এটা পরিষ্কার যে সারা পৃথিবীর ধর্মগুলো মৃত্যুর পর জীবন সম্বন্ধে অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত বিশ্বাস গড়ে নিয়েছে আর এই সমস্ত বিশ্বাসের ভিত্তি হল মানুষের মধ্যে অমর কিছু আছে। আর এই বিশ্বাস কোটি কোটি লোকের ওপর ছাপ ফেলেছে, তাদেরকে এর দাস করে রেখেছে। এই সমস্ত বিষয়ের মুখোমুখি হয়ে আমরা এটা জিজ্ঞাসা করতে বাধ্য হই: আমরা মারা গেলে কী হয় তা জানতে পারা কি সম্ভব? মৃত্যুর পরে কি সত্যিই জীবন রয়েছে? বাইবেল এই বিষয়ে কী বলে? পরের প্রবন্ধে আমরা এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করব।
[পাদটীকাগুলো]
a এল-আমারনা হল মিশরীয় শহর আখেটাটটেন এর ধ্বংসাবশেষ আর দাবি করা হয় যে এটা সা.কা.পূ. চতুর্দশ শতাব্দীতে বানানো হয়েছিল।
আপনি কি ব্যাখ্যা করতে পারেন?
◻ বেশিরভাগ ধর্মে মৃত্যুর পরে জীবন সম্পর্কে কোন্ একই শিক্ষা পাওয়া যায়?
◻ ইতিহাস ও বাইবেল থেকে কীভাবে জানা যায় যে অমর আত্মা-র শিক্ষার শুরু প্রাচীন বাবিলনে হয়েছিল?
◻ বাবিলনীয় অমর আত্মার শিক্ষা কীভাবে প্রাচ্যের ধর্মগুলোতে ছাপ ফেলেছিল?
◻ যিহূদী ধর্ম, খ্রীষ্টীয়জগৎ ও ইসলাম ধর্মে কীভাবে অমর আত্মার শিক্ষা এসেছিল?
[১২ পৃষ্ঠার চিত্র]
মহান আলেকজান্ডারের বিজয় গ্রিক ও যিহূদী সংস্কৃতির এক অদ্ভুত মিশ্রন ঘটিয়েছিল
[১৩ পৃষ্ঠার চিত্র]
প্লেটোর দর্শনবাদকে অগাস্টিন খ্রীষ্টধর্মের সঙ্গে মেশাতে চেষ্টা করেছিলেন
[Credit Lines]
আলেকজান্ডার: Musei Capitolini, Roma; অগাস্টিন: From the book Great Men and Famous Women