আরিষ্টার্খ—একজন নিষ্ঠাবান সঙ্গী
প্রেরিত পৌলের বহু নির্ভরযোগ্য সহকার্যকারীদের মধ্যে আরিষ্টার্খ ছিলেন একজন। আপনার কী মনে হয় যখন আপনি তার নাম শোনেন? কোন কিছু মনে হয় কি? প্রাথমিক খ্রীষ্টীয় ইতিহাসের পূর্ণতায় তিনি কোন্ ভূমিকা পালন করেছিলেন তা কি আপনি বলতে পারবেন? যদিও আরিষ্টার্খ হয়ত এমন বাইবেল চরিত্রগুলির মধ্যে নেই যাদের সাথে আমরা খুব বেশি পরিচিত, তথাপি তিনি খ্রীষ্টীয় গ্রীক শাস্ত্রাবলীতে বর্ণিত বেশ কিছু ঘটনার সাথে জড়িত ছিলেন।
তাহলে, আরিষ্টার্খ কে ছিলেন? পৌলের সাথে তার কী সম্পর্ক ছিল? কেন এটি বলা যেতে পারে যে আরিষ্টার্খ একজন নিষ্ঠাবান সঙ্গী ছিলেন? আর তার উদাহরণ পরীক্ষা করে আমরা কোন্ শিক্ষা লাভ করতে পারি?
প্রেরিত পুস্তকের বিবরণে, ইফিষ শহরের এক উত্তেজিত জনতার চিৎকার এবং বিশৃঙ্খলার মাঝে আরিষ্টার্খের নাটকীয় প্রবেশ ঘটে। (প্রেরিত ১৯:২৩-৪১) মিথ্যা দেবী দিয়ানার রৌপ্যময় মন্দির তৈরি করা দীমীত্রিয় এবং অন্যান্য ইফিষীয় রৌপ্যকারদের জন্য একটি লাভজনক ব্যবসা ছিল। অতএব, শহরটিতে পৌলের প্রচার অভিযান যখন শহরের বেশ কিছু সংখ্যক ব্যক্তিদের এই দেবীর অপরিচ্ছন্ন উপাসনা ত্যাগ করতে পরিচালিত করেছিল, দীমীত্রিয় অন্যান্য কারিগরদের উত্তেজিত করেছিলেন। তিনি তাদের বলেছিলেন যে পৌলের প্রচার কেবলমাত্র তাদের আর্থিক নিরাপত্তার প্রতিই ভীতি প্রদর্শন করে না, বরঞ্চ দীয়ানার উপাসনার শেষ আনার সম্ভাবনাকেও উত্থাপিত করেছে।
পৌলকে খুঁজে না পেয়ে, ক্রুদ্ধ জনতা তার সঙ্গী আরিষ্টার্খ এবং গায়কে জোরপূর্বক রঙ্গভূমিতে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। যেহেতু তারা বেশ বিপদের মধ্যে ছিলেন, তাই পৌলের বন্ধুরা তাকে বিনতি করেছিলেন যেন তিনি “রঙ্গভূমিতে আপনার বিপদ ঘটাইতে না যান।”
নিজেকে সেই পরিস্থিতিতে কল্পনা করুন। দুই ঘন্টা ধরে, উত্তেজিত জনতা এই বলে চিৎকার করে চলেছিল, “ইফিষীয়দের দীয়ানাই মহাদেবী।” নিজস্ব পক্ষসমর্থনের জন্য কথা বলতে অসমর্থ অবস্থায় সেই গোঁড়া জনতার নিয়ন্ত্রণাধীনে নিজেদের দেখতে পাওয়া আরিষ্টার্খ এবং গায়ের জন্য প্রকৃতই একটি আতঙ্কজনক পরীক্ষা ছিল। জীবিত বের হয়ে আসতে পারবেন কি না সেই বিষয়ে তারা অবশ্যই মনে মনে চিন্তা করছিলেন। আনন্দের বিষয় যে, তারা পেরেছিলেন। বাস্তবিকপক্ষে, লূকের বিবরণের সুস্পষ্টতা কয়েকজন পণ্ডিতকে এটি উল্লেখ করতে পরিচালিত করেছিল যে তিনি প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের সাক্ষ্যগুলি ব্যবহার করেছিলেন, সম্ভবত স্বয়ং আরিষ্টার্খ এবং গায়ের সাক্ষ্য।
শহরটির সম্পাদক অবশেষে বিক্ষোভকে শান্ত করেছিলেন। তাদের নির্দোষ অবস্থা সম্বন্ধে তার নিরপেক্ষ স্বীকারোক্তি শোনা এবং তাদের বেষ্টনকারী উচ্ছৃঙ্খল জনতার চলে যাওয়াকে দেখা অবশ্যই আরিষ্টার্খ ও গায়ের জন্য অত্যন্ত স্বস্তিকর ছিল।
এইধরনের একটি অভিজ্ঞতার পর আপনার অনুভূতি কেমন হত? আপনি কি এই উপসংহারে আসতেন যে পৌলের একজন মিশনারী সঙ্গী হওয়া আপনার জন্য নয়, কারণ এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক আর এক নির্ঝঞ্ঝাট জীবনের অন্বেষণ করাই আপনার পক্ষে উত্তম। আরিষ্টার্খ এইধরনের চিন্তা করেননি! থিষলনীকী থেকে আসার দরুন, সম্ভবত ইতিমধ্যেই তিনি সুসমাচার ঘোষণার বিপদগুলি সম্বন্ধে ভালভাবে অবগত ছিলেন। কেবলমাত্র দুই বছর পূর্বে পৌল যখন তার শহরে প্রচার করেছিলেন, সেখানেও একটি দাঙ্গা শুরু হয়েছিল। (প্রেরিত ১৭:১-৯; ২০:৪) আরিষ্টার্খ নিষ্ঠাপূর্ণভাবে পৌলের সাথে ছিলেন।
গ্রীস থেকে যিরূশালেম
রৌপ্যকারের দাঙ্গার কয়েক মাস পরে, পৌল গ্রীসে ছিলেন এবং যিরূশালেমের পথে সুরিয়ার উদ্দেশ্যে জলপথে যাত্রা করতে উদ্যত হয়েছিলেন যখন ‘যিহূদীরা তাঁহার বিপক্ষে ষড়যন্ত্র করিয়াছিল।’ (প্রেরিত ২০:২, ৩) এই বিপজ্জনক পরিস্থিতিগুলিতে পৌলের সাথে আমরা কাকে দেখতে পাই? আরিষ্টার্খ!
এই নতুন ভীতি পৌল, আরিষ্টার্খ ও তাদের সঙ্গীদের পরিকল্পনা পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছিল, প্রথমে তারা মাকিদনিয়া এবং পরে পাতারার ফৈনীকিয়ার উদ্দেশ্যে চূড়ান্তভাবে জাহাজে ওঠার পূর্বে এশিয়া মাইনরের উপকূল বরাবর ভ্রমণ করেছিলেন। (প্রেরিত ২০:৪, ৫, ১৩-১৫; ২১:১-৩) এই যাত্রার উদ্দেশ্য স্পষ্টতই মাকিদনিয়া এবং আখায়ার খ্রীষ্টানদের দান যিরূশালেমে তাদের অভাবগ্রস্ত ভাইদের দেওয়ার জন্য ছিল। (প্রেরিত ২৪:১৭; রোমীয় ১৫:২৫, ২৬) একসাথে অনেকে ভ্রমণ করেছিলেন, সম্ভবত বিভিন্ন মণ্ডলী তাদের এই দায়িত্ব দিয়েছিল। নিঃসন্দেহে, এইরূপ একটি বৃহৎ দল তাদের আরও বেশি নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করবে।
আরিষ্টার্খ যিরূশালেম থেকে গ্রীসে পৌলের সাথে যাওয়ার এক মহান সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু, তাদের পরবর্তী যাত্রা তাদের যিহূদা থেকে রোমে নিয়ে যায়।
রোম অভিমুখে যাত্রা
এই সময়ে পরিস্থিতি অনেকটাই পৃথক ছিল। পৌল দুই বছরের জন্য কৈসরিয়ায় আটক ছিলেন, কৈসরের কাছে আপীল করেছিলেন এবং তাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় রোমে পাঠান হবে। (প্রেরিত ২৪:২৭; ২৫:১১, ১২) পৌলের সঙ্গীরা কেমন বোধ করেছিলেন তা কল্পনা করার চেষ্টা করুন। এক অকল্পনীয় পরিণতি সহ কৈসরিয়া থেকে রোম অভিমুখে যাত্রা হবে দীর্ঘ এবং আবেগের দিক দিয়ে ক্লেশকর ছিল। সমর্থন এবং সান্ত্বনা প্রদানের জন্য কে তার সাথে যেতে পারেন? দুইজন ব্যক্তিকে মনোনীত করা হয়েছিল অথবা স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে তারা নিজেদের প্রাপ্তিসাধ্য করেছিলেন। তারা ছিলেন আরিষ্টার্খ এবং প্রেরিত পত্রের লেখক লূক।—প্রেরিত ২৭:১, ২.
রোমে যাত্রার প্রথম পর্যায়ে কিভাবে লূক এবং আরিষ্টার্খ একই জাহাজে উঠতে সক্ষম হয়েছিলেন? ইতিহাসবেত্তা যোজেপ্পী রিকোটি উল্লেখ করেন: “এই দুইজন বেসরকারী যাত্রী হিসাবে জাহাজে উঠেছিলেন . . . অথবা খুব সম্ভবত শতপতির দয়ায় প্রবেশ করতে পেরেছিলেন যিনি তাদের পৌলের দাস হিসাবে গণ্য করার ভান করেছিলেন, যেহেতু আইন একজন রোমীয় নাগরিককে দুজন দাস সঙ্গে নেওয়াকে অনুমোদন করত।” তাদের উপস্থিতি এবং উৎসাহের দ্বারা পৌল অবশ্যই কতই না উৎসাহিত হয়েছিলেন!
লূক এবং আরিষ্টার্খ তাদের জীবন হারানোর ঝুঁকি নিয়ে পৌলের প্রতি তাদের প্রেম প্রদর্শন করেছিলেন। বাস্তবিকপক্ষে, তারা তাদের বন্দী সঙ্গীর সাথে জীবনাশঙ্কাজনক পরিস্থিতি অভিজ্ঞতা করেছিলেন যখন মিলিতা দ্বীপে তাদের জাহাজ ভেঙ্গে গিয়েছিল।—প্রেরিত ২৭:১৩–২৮:১.
পৌলের “সহবন্দি”
যখন পৌল সা.কা. ৬০-৬১ সালে কলসীয়দের এবং ফিলীমনের প্রতি তার পত্রগুলি লিখেছিলেন, আরিষ্টার্খ এবং লূক তখনও তার পাশে রোমে ছিলেন। আরিষ্টার্খ এবং ইপাফ্রাকে পৌলের “সহবন্দি” হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। (কলসীয় ৪:১০, ১৪; ফিলীমন ২৩, ২৪) অতএব, কিছু সময়ের জন্য আরিষ্টার্খ স্পষ্টতই পৌলের বন্দীত্বে অংশ নিয়েছিলেন।
যদিও পৌল রোমে অন্তত দুই বছর বন্দী ছিলেন, তিনি তার নিজস্ব ভাড়াকৃত গৃহে পাহারার অধীনে বসবাস করার অনুমোদন পেয়েছিলেন যেখানে তিনি সাক্ষাৎকারীদের কাছে সুসমাচার ঘোষণা করতে পারতেন। (প্রেরিত ২৮:১৬, ৩০) আরিষ্টার্খ, ইপাফ্রা, লূক এবং অন্যান্যেরা তখন পৌলকে সাহায্য এবং সহ্য করার শক্তি দান করার মাধ্যমে তার পরিচর্যা করেছিলেন।
“সান্ত্বনাজনক”
অনুপ্রাণিত বাইবেল নথির বিভিন্ন ঘটনাবলি যেখানে আরিষ্টার্খকে দেখা যায় সেইগুলি বিবেচনা করার পর কোন্ চিত্র প্রকাশিত হয়? লেখক ডব্লিউ. ডি. থমাসের বক্তব্য অনুসারে, আরিষ্টার্খ “এমন একজন ব্যক্তি হিসাবে স্বতন্ত্র যিনি বিরোধিতার মুখোমুখি হতে এবং সম্পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে টিকে থাকতে পারতেন এবং সর্বদা সেবা করা ছিল তার দৃঢ়সংকল্প। তিনি এমন একজন ব্যক্তি হিসাবে স্বতন্ত্র যিনি কেবলমাত্র সুদিনগুলিতে যখন নীল আকাশ থেকে সূর্য দীপ্তি দেয় তখনই ঈশ্বরকে প্রেম করেননি কিন্তু তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যেও করেছিলেন।”
পৌল বলেন যে আরিষ্টার্খ এবং অন্যান্যেরা তার কাছে “সান্ত্বনাজনক” (গ্রীক, পেরিগোরিয়া) ছিলেন যা হল সান্ত্বনার এক উৎস। (কলসীয় ৪:১০, ১১) অতএব পৌলকে সান্ত্বনা এবং উৎসাহ দেওয়ার মাধ্যমে, আরিষ্টার্খ প্রয়োজনের সময় একজন প্রকৃত সঙ্গী হয়েছিলেন। বেশ কয়েক বছরের জন্য প্রেরিতের সংসর্গ এবং বন্ধুত্ব লাভ করা অবশ্যই অত্যন্ত সন্তোষদায়ক এবং আধ্যাত্মিকভাবে সমৃদ্ধময় অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
আমরা হয়ত সম্পূর্ণভাবে নিজেদের এতটা নাটকীয় পরিস্থিতিতে খুঁজে পাব না যা আরিষ্টার্খ অভিজ্ঞতা করেছিলেন। কিন্তু, আজকে খ্রীষ্টীয় মণ্ডলীর সকলের, খ্রীষ্টের আধ্যাত্মিক ভাইদের এবং যিহোবার সংগঠনের প্রতি অনুরূপ নিষ্ঠা থাকা প্রয়োজন। (মথি ২৫:৩৪-৪০ পদের সাথে তুলনা করুন।) একদিন না একদিন, সেই সহউপাসকেরা যাদের আমরা চিনি তারা সম্ভবত প্রিয়জনের মৃত্যু, অসুস্থতা অথবা অন্যান্য পরীক্ষাগুলি কারণে মন্দ অবস্থা অথবা যন্ত্রণা ভোগ করবে। তাদের সাথে থেকে এবং সাহায্য, সান্ত্বনা ও উৎসাহ দিয়ে আমরা আনন্দ খুঁজে পেতে পারি এবং নিজেদের নিষ্ঠাবান সঙ্গী হিসাবে প্রমাণ করতে পারি।—হিতোপদেশ ১৭:১৭ পদের সাথে তুলনা করুন; প্রেরিত ২০:৩৫.