-
“খ্রীষ্ট ঈশ্বরেরই পরাক্রম”যিহোবার নিকটবর্তী হোন
-
-
অধ্যায় ৯
“খ্রীষ্ট ঈশ্বরেরই পরাক্রম”
১-৩. (ক) গালীল সমুদ্রে শিষ্যদের কোন আতঙ্কজনক অভিজ্ঞতা হয়েছিল আর যিশু কী করেছিলেন? (খ) কেন যিশুকে উপযুক্তভাবে “খ্রীষ্ট ঈশ্বরেরই পরাক্রম” বলা হয়?
শিষ্যরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তারা নৌকায় চড়ে গালীল সাগর পাড়ি দেওয়ার সময় হঠাৎ করে এক ঝড়ের কবলে পড়ে যায়। কোনো সন্দেহ নেই যে, এর আগেও তারা এই হ্রদে ঝড় হতে দেখেছে—অধিকন্তু, তাদের মধ্যে কয়েক জন অভিজ্ঞ জেলে ছিল।a (মথি ৪:১৮, ১৯) কিন্তু, এটা এক “ভারী ঝড়” ছিল এবং এটা নিমিষের মধ্যে সমুদ্রকে উত্তাল করে দিয়েছিল। এই ব্যক্তিরা মরিয়াভাবে নৌকার হাল ধরে রাখার চেষ্টা করেছিল কিন্তু সেই ঝড় কেবল প্রবলই হচ্ছিল। তরঙ্গ উদ্বেলিত ঢেউগুলো “নৌকায় এমনি আঘাত” করছিল যে তা জলে পূর্ণ হতে শুরু করে। এত হইচই সত্ত্বেও, যিশু নৌকার পিছনের দিকে ঘুমিয়েছিলেন কারণ সারাদিন জনতাকে শিক্ষা দেওয়ার ফলে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। শিষ্যরা তাদের জীবনের ভয়ে, তাঁকে এই বলে জাগিয়ে তুলেছিল: “হে প্রভু, রক্ষা করুন, আমরা মারা পড়িলাম।”—মার্ক ৪:৩৫-৩৮; মথি ৮:২৩-২৫.
২ যিশু ভয় পাননি। সম্পূর্ণ আস্থা নিয়ে, তিনি বাতাস ও সমুদ্রকে ধমক দিয়েছিলেন: “নীরব হও, স্থির হও।” সঙ্গে সঙ্গে বাতাস ও সমুদ্র কথা শুনেছিল—ঝড় থেমে গিয়েছিল, ঢেউ শান্ত হয়ে গিয়েছিল এবং “মহাশান্তি” হয়েছিল। তখন এক অস্বাভাবিক ভয় শিষ্যদের ঘিরে ধরেছিল। তারা ফিসফিস করে একে অন্যকে বলেছিল, “ইনি তবে কে?” সত্যিই তো, কী ধরনের ব্যক্তি বাতাস ও সমুদ্রকে ধমক দিতে পারেন, যেন এক অদম্য বাচ্চাকে শাসন করছেন?—মার্ক ৪:৩৯-৪১; মথি ৮:২৬, ২৭.
৩ কিন্তু যিশু কোনো সাধারণ মানুষ ছিলেন না। যিহোবার শক্তি তাঁর প্রতি এবং তাঁর মাধ্যমে বিভিন্ন অসাধারণ উপায়ে প্রদর্শিত হয়েছিল। অনুপ্রাণিত হয়ে প্রেরিত পৌল উপযুক্তভাবেই তাঁকে “খ্রীষ্ট ঈশ্বরেরই পরাক্রম” হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। (১ করিন্থীয় ১:২৪) কোন কোন উপায়ে ঈশ্বরের শক্তি যিশুতে প্রকাশিত হয়েছিল? আর যিশুর শক্তির ব্যবহার আমাদের জীবনে কোন প্রভাব ফেলতে পারে?
ঈশ্বরের একজাত পুত্রের শক্তি
৪, ৫. (ক) যিহোবা তাঁর একজাত পুত্রকে কোন শক্তি ও কর্তৃত্ব দিয়েছিলেন? (খ) এই পুত্র তাঁর পিতার সৃষ্টি সম্বন্ধীয় উদ্দেশ্যগুলো পূর্ণ করতে কীভাবে সুসজ্জিত ছিলেন?
৪ মানুষ হওয়ার পূর্বে যিশুর যে-শক্তি ছিল, তা বিবেচনা করুন। যিহোবা তাঁর একজাত পুত্রকে সৃষ্টি করার সময় তাঁর “অনন্ত পরাক্রম” ব্যবহার করেছিলেন, যিনি পরে যিশু খ্রিস্ট হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন। (রোমীয় ১:২০; কলসীয় ১:১৫) এরপর, যিহোবা এই পুত্রকে প্রচুর শক্তি ও কর্তৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁকে তাঁর সৃষ্টি সম্বন্ধীয় উদ্দেশ্যগুলো পূর্ণ করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এই পুত্র সম্বন্ধে বাইবেল বলে: “সকলই তাঁহার দ্বারা হইয়াছিল, যাহা হইয়াছে, তাহার কিছুই তাঁহা ব্যতিরেকে হয় নাই।”—যোহন ১:৩.
৫ সেই দায়িত্ব কতটা ব্যাপক ছিল, তা আমরা খুব সামান্যই উপলব্ধি করতে পারি। লক্ষ লক্ষ শক্তিশালী দূত, কোটি কোটি ছায়াপথ সহ ভৌত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এবং বিভিন্ন ধরনের জীবিত বস্তু সহ পৃথিবীকে অস্তিত্বে আনতে কতটা শক্তির প্রয়োজন হয়েছিল, তা কল্পনা করুন। সেই কাজগুলো সম্পাদন করার জন্য একজাত পুত্রের নিয়ন্ত্রণে ছিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে সক্রিয় শক্তি—ঈশ্বরের পবিত্র আত্মা। এই পুত্র সুদক্ষ কর্মী হয়ে অনেক আনন্দ পেয়েছিলেন, যাঁকে যিহোবা অন্য সমস্তকিছু সৃষ্টি করায় ব্যবহার করেছিলেন।—হিতোপদেশ ৮:২২-৩১, NW.
৬. পৃথিবীতে যিশুর মৃত্যু ও পুনরুত্থানের পর, তাঁকে কোন শক্তি ও কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছিল?
৬ একজাত পুত্র কি আরও শক্তি ও কর্তৃত্ব লাভ করতে পেরেছিলেন? যিশু পৃথিবীতে তাঁর মৃত্যু ও পুনরুত্থানের পর বলেছিলেন: “স্বর্গে ও পৃথিবীতে সমস্ত কর্ত্তৃত্ব আমাকে দত্ত হইয়াছে।” (মথি ২৮:১৮) হ্যাঁ, যিশুকে পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে শক্তি ব্যবহার করার ক্ষমতা ও অধিকার দেওয়া হয়েছে। “রাজাদের রাজা ও প্রভুদের প্রভু” হিসেবে, তাঁর পিতার বিরুদ্ধে থাকা দৃশ্য ও অদৃশ্য “সমস্ত আধিপত্য এবং সমস্ত কর্ত্তৃত্ব ও পরাক্রম লোপ” করার ক্ষমতা তাঁকে দেওয়া হয়েছে। (প্রকাশিত বাক্য ১৯:১৬; ১ করিন্থীয় ১৫:২৪-২৬) যিহোবা নিজেকে বাদ দিয়ে যিশুর “অনধীন কিছুই অবশিষ্ট রাখেন নাই।”—ইব্রীয় ২:৮; ১ করিন্থীয় ১৫:২৭.
৭. কেন আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি যে, যিশুকে যিহোবা যে-শক্তি দিয়েছেন, তিনি কখনোই সেটার অপব্যবহার করবেন না?
৭ যিশু তাঁর শক্তির অপব্যবহার করতে পারেন এই ভেবে কি আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার দরকার আছে? অবশ্যই নয়! যিশু তাঁর পিতাকে সত্যিই ভালবাসেন এবং কখনোই এমন কোনো কিছুই করবেন না, যা তাঁকে অখুশি করে। (যোহন ৮:২৯; ১৪:৩১) যিশু ভালভাবেই জানেন যে, যিহোবা কখনোই তাঁর সর্বজনীন শক্তির অপব্যবহার করেন না। যিশু সরাসরি দেখেছেন যে, যিহোবার “প্রতি যাহাদের অন্তঃকরণ একাগ্র, তাহাদের পক্ষে আপনাকে বলবান দেখাইবার জন্য” তিনি সুযোগ খোঁজেন। (২ বংশাবলি ১৬:৯) বাস্তবিকপক্ষে, যিশু মানবজাতির জন্য তাঁর পিতার প্রেমে অংশ নেন, তাই আমরা আস্থা রাখতে পারি যে যিশু সবসময় তাঁর শক্তি উপকারের জন্যই ব্যবহার করবেন। (যোহন ১৩:১) আর যিশু এই ক্ষেত্রে এক নিখুঁত নথি স্থাপন করেছেন। আসুন আমরা বিবেচনা করি যে, পৃথিবীতে থাকাকালীন তাঁর কতটা শক্তি ছিল এবং তিনি কীভাবে তা ব্যবহার করার জন্য পরিচালিত হয়েছিলেন।
“বাক্যে পরাক্রমী”
৮. যিশু তাঁর অভিষেকের পর কী করার শক্তি পেয়েছিলেন এবং তিনি কীভাবে তাঁর শক্তি ব্যবহার করতেন?
৮ স্পষ্টতই, যিশু যখন নাসরতে বড় হচ্ছিলেন, তখন কোনো অলৌকিক কাজ করেননি। কিন্তু সা.কা. ২৯ সালে, প্রায় ৩০ বৎসর বয়সে তিনি বাপ্তিস্ম নেওয়ার পর সেটার পরিবর্তন ঘটে। (লূক ৩:২১-২৩) বাইবেল আমাদের বলে: “ঈশ্বর তাঁহাকে পবিত্র আত্মাতে ও পরাক্রমে অভিষেক করিয়াছিলেন; তিনি হিতকার্য্য করিয়া বেড়াইতেন, এবং দিয়াবল কর্ত্তৃক পীড়িত সকল লোককে সুস্থ করিতেন।” (প্রেরিত ১০:৩৮) ‘হিতকার্য্য করা’—এটা কি ইঙ্গিত করে না যে, যিশু তাঁর শক্তি সঠিকভাবে ব্যবহার করতেন? তাঁর অভিষেকের পর, তিনি “কার্য্যে ও বাক্যে পরাক্রমী ভাববাদী” হয়েছিলেন।—লূক ২৪:১৯.
৯-১১. (ক) যিশু তাঁর বেশির ভাগ শিক্ষা কোথায় দিয়েছিলেন এবং তিনি কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হয়েছিলেন? (খ) যিশু যেভাবে শিক্ষা দিতেন, তা দেখে লোকেরা কেন অবাক হয়ে গিয়েছিল?
৯ যিশু কীভাবে বাক্যে পরাক্রমী ছিলেন? তিনি প্রায়ই খোলা আকাশের নিচে—হ্রদের তীরে, পাহাড়ে ও সেইসঙ্গে রাস্তায় ও বাজারে—শিক্ষা দিতেন। (মার্ক ৬:৫৩-৫৬; লূক ৫:১-৩; ১৩:২৬) যদি তাঁর বাক্যগুলো শ্রোতাদের মধ্যে আগ্রহ না জাগাত, তা হলে তারা চাইলেই সেখান থেকে চলে যেতে পারত। ছাপানো বইপত্র আসার আগের যুগে, উপলব্ধিপূর্ণ শ্রোতাদের তাঁর বাক্যগুলো তাদের মনে ও হৃদয়ে রাখতে হতো। তাই, যিশুর শিক্ষাগুলো এমন হওয়া দরকার ছিল যা, মনোযোগ আকর্ষণ করে, স্পষ্টভাবে বোঝা যায় ও সহজেই মনে রাখা যায়। কিন্তু এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা যিশুর জন্য কোনো সমস্যাই তৈরি করতে পারেনি। উদাহরণ হিসেবে, তাঁর পর্বতে দত্ত উপদেশের কথা বিবেচনা করুন।
১০ সাধারণ কাল ৩১ সালের গোড়ার দিকে এক সকালে, গালীল সমুদ্রের কাছে একটা পাহাড়ে এক দল লোক জড়ো হয়েছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ১০০ থেকে ১১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত যিহূদা ও যিরূশালেম থেকে এসেছিল। অন্যেরা উত্তরে অবস্থিত সোর ও সীদোনের সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা থেকে এসেছিল। অনেক অসুস্থ ব্যক্তি যিশুকে স্পর্শ করার জন্য তাঁর কাছে গিয়েছিল আর তিনি তাদের সবাইকে সুস্থ করেছিলেন। যখন তাদের মধ্যে গুরুতরভাবে অসুস্থ একজন ব্যক্তিও আর বাকি ছিল না, তখন তিনি শিক্ষা দিতে শুরু করেছিলেন। (লূক ৬:১৭-১৯) কিছু সময় পরে তিনি যখন কথা বলা শেষ করেছিলেন, তখন তারা যা শুনেছিল তাতে অবাক হয়ে গিয়েছিল। কেন?
১১ কয়েক বছর পর, সেই উপদেশ শুনেছিলেন এমন একজন ব্যক্তি লিখেছিলেন: “লোকসমূহ তাঁহার উপদেশে চমৎকার জ্ঞান করিল; কারণ তিনি ক্ষমতাপন্ন ব্যক্তির ন্যায় তাহাদিগকে উপদেশ দিতেন।” (মথি ৭:২৮, ২৯) যিশু যে শক্তির সঙ্গে কথা বলেছিলেন, তা তারা উপলব্ধি করতে পেরেছিল। তিনি ঈশ্বরের পক্ষে কথা বলেছিলেন এবং তাঁর শিক্ষা যে ঈশ্বরের বাক্য থেকে, তা দৃঢ়ভাবে তুলে ধরেছিলেন। (যোহন ৭:১৬) যিশুর কথাগুলো স্পষ্ট ছিল, তাঁর পরামর্শগুলো বিশ্বাস উৎপাদন করার মতো ক্ষমতাসম্পন্ন এবং তাঁর যুক্তি অখণ্ডনীয় ছিল। তাঁর বাক্যগুলো বিভিন্ন বিচার্য বিষয়ের কেন্দ্রস্থলে ও সেইসঙ্গে তাঁর শ্রোতাদের হৃদয়ে পৌঁছেছিল। কীভাবে সুখ খুঁজে পাওয়া যায়, কীভাবে প্রার্থনা করতে হয়, কীভাবে ঈশ্বরের রাজ্যের অন্বেষণ করতে হয় এবং কীভাবে এক নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা যায়, সেই বিষয়ে তিনি তাদের শিক্ষা দিয়েছিলেন। (মথি ৫:৩–৭:২৭) তাঁর বাক্যগুলো সেই ব্যক্তিদের হৃদয়কে জাগিয়ে তুলেছিল, যারা সত্য ও ধার্মিকতার জন্য ক্ষুধার্ত ছিল। এইরকম ব্যক্তিরা নিজেদের “অস্বীকার” করতে এবং তাঁকে অনুসরণ করার জন্য সমস্তকিছু ত্যাগ করতে ইচ্ছুক ছিল। (মথি ১৬:২৪; লূক ৫:১০, ১১) যিশুর বাক্যগুলোর শক্তি সম্বন্ধে কী এক প্রামাণিক সাক্ষ্য!
‘কার্য্যে পরাক্রমী’
১২, ১৩. কোন অর্থে যিশু ‘কার্য্যে পরাক্রমী’ ছিলেন এবং তাঁর অলৌকিক কাজগুলোর মধ্যে কোন বৈচিত্র্য ছিল?
১২ যিশু ‘কার্য্যেও পরাক্রমী’ ছিলেন। (লূক ২৪:১৯) সুসমাচারগুলো তাঁর দ্বারা সম্পাদিত ৩০টা নির্দিষ্ট অলৌকিক কাজের কথা বর্ণনা করে—যেগুলোর সমস্তই ‘প্রভুর [“যিহোবার,” NW] শক্তিতে’ করা হয়েছিল।b (লূক ৫:১৭) যিশুর অলৌকিক কাজগুলো হাজার হাজার লোকের জীবনকে প্রভাবিত করেছিল। শুধুমাত্র দুটো অলৌকিক কাজ—“স্ত্রী ও শিশু ছাড়া” ৫,০০০ ও পরে ৪,০০০ পুরুষকে খাওয়ানো—সবমিলিয়ে সম্ভবত প্রায় ২০,০০০ লোককে অন্তর্ভুক্ত করেছিল!—মথি ১৪:১৩-২১; ১৫:৩২-৩৮.
‘তাঁহারা যীশুকে দেখিতে পাইলেন, তিনি সমুদ্রের উপর দিয়া হাঁটিতেছেন’
১৩ যিশুর অলৌকিক কাজগুলোর মধ্যে ব্যাপক বৈচিত্র্য ছিল। মন্দ দূতেদের ওপর তাঁর কর্তৃত্ব ছিল, তিনি অনায়াসে তাদেরকে বের করে দিতে পারতেন। (লূক ৯:৩৭-৪৩) ভৌত উপাদানগুলোর ওপরও তাঁর ক্ষমতা ছিল, যেমন জলকে দ্রাক্ষারসে পরিণত করা। (যোহন ২:১-১১) শিষ্যদের অবাক করে দিয়ে, তিনি বায়ু প্রবাহিত গালীল সমুদ্রের উপর দিয়ে হেঁটে গিয়েছিলেন। (যোহন ৬:১৮, ১৯) রোগের ওপর তাঁর কর্তৃত্ব ছিল, তিনি শারীরিক ত্রুটি, দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা এবং জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ এমন রোগব্যাধি সারিয়ে তুলেছিলেন। (মার্ক ৩:১-৫; যোহন ৪:৪৬-৫৪) তিনি সুস্থ করার এই কাজগুলো বিভিন্ন উপায়ে করেছিলেন। কেউ কেউ অনেক দূর থেকে সুস্থ হয়েছিল আর অন্যেরা যিশুর সামান্য স্পর্শে সুস্থ হয়েছিল। (মথি ৮:২, ৩, ৫-১৩) কেউ কেউ সঙ্গে সঙ্গে সুস্থ হয়ে গিয়েছিল আবার অন্যেরা ধীরে ধীরে।—মার্ক ৮:২২-২৫; লূক ৮:৪৩, ৪৪.
১৪. কোন পরিস্থিতিগুলোতে যিশু দেখিয়েছিলেন যে মৃত্যু থেকে ফিরিয়ে আনার শক্তি তাঁর রয়েছে?
১৪ লক্ষণীয় বিষয়টি হল, মৃত্যু থেকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার শক্তি যিশুর ছিল। লিপিবদ্ধ তিনটে ঘটনায় তিনি মৃতদের উত্থাপিত করেছিলেন, ১২ বছরের এক মেয়েকে তার বাবামার কাছে, একমাত্র সন্তানকে তার বিধবা মায়ের কাছে এবং এক প্রিয় ভাইকে তার বোনদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। (লূক ৭:১১-১৫; ৮:৪৯-৫৬; যোহন ১১:৩৮-৪৪) কোনো পরিস্থিতিকেই কঠিন বলে মনে হয়নি। তিনি ১২ বছরের এক মেয়েকে মারা যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই তার মৃত্যুশয্যা থেকে উত্থাপিত করেছিলেন। তিনি বিধবার ছেলেকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার খাট থেকে পুনরুত্থিত করেছিলেন আর কোনো সন্দেহ নেই যে, ছেলেটি যেদিন মারা গিয়েছিল সেদিনই তা করা হয়েছিল। আর লাসার মারা যাওয়ার চার দিন পরে তিনি তাঁকে কবর থেকে পুনরুত্থিত করেছিলেন।
নিঃস্বার্থভাবে, দায়িত্ব এবং বিবেচনার সঙ্গে শক্তির ব্যবহার
১৫, ১৬. কোন প্রমাণ রয়েছে যে, যিশু নিঃস্বার্থভাবে তাঁর শক্তি ব্যবহার করতেন?
১৫ যিশুর ক্ষমতা যদি একজন অসিদ্ধ শাসকের হাতে দেওয়া হতো, তা হলে এর অপব্যবহার হওয়ার সম্ভাবনার কথা কি আপনি কল্পনা করতে পারেন? কিন্তু যিশু নিষ্পাপ ছিলেন। (১ পিতর ২:২২) তিনি স্বার্থপরতা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং লোভের দ্বারা কলুষিত হওয়াকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, যেগুলো অসিদ্ধ মানুষদের তাদের ক্ষমতাকে অন্যদের ক্ষতি করার জন্য ব্যবহার করতে পরিচালিত করে।
১৬ যিশু তাঁর শক্তি নিঃস্বার্থভাবে ব্যবহার করতেন, এটাকে কখনও ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য কাজে লাগাননি। তিনি যখন ক্ষুধার্ত ছিলেন, তখন নিজের জন্য পাথরকে রুটি বানাতে রাজি হননি। (মথি ৪:১-৪) তাঁর অল্প জিনিসপত্র প্রমাণ করেছিল যে, বস্তুগত লাভের জন্য তিনি তাঁর শক্তি ব্যবহার করেননি। (মথি ৮:২০) আরও প্রমাণ রয়েছে যে তাঁর শক্তিশালী কাজগুলো নিঃস্বার্থ প্রেরণা থেকে এসেছিল। অলৌকিক কাজগুলো করার সময় তাঁকে কিছু ত্যাগ করতে হতো। অসুস্থদের সুস্থ করার সময় তাঁর মধ্যে থেকে শক্তি বেরিয়ে যেত। এই শক্তি বেরিয়ে যাওয়ার সময় তিনি বুঝতে পারতেন, এমনকি শুধুমাত্র একটা আরোগ্য করা হলেও। (মার্ক ৫:২৫-৩৪) তবুও, তিনি সমস্ত লোককে তাঁকে স্পর্শ করতে দিতেন আর তারা সুস্থ হতো। (লূক ৬:১৯) কত নিঃস্বার্থ মনোভাব!
১৭. যিশু কীভাবে দেখিয়েছিলেন যে তিনি দায়িত্বের সঙ্গে তাঁর শক্তি ব্যবহার করতেন?
১৭ যিশু দায়িত্বের সঙ্গে তাঁর শক্তি ব্যবহার করতেন। তিনি কখনোই শুধু নিজেকে জাহির করার জন্য বা অযথা লোক দেখানোর জন্য অলৌকিক কাজগুলো করেননি। (মথি ৪:৫-৭) তিনি শুধুমাত্র হেরোদের ভুল কৌতূহল মেটানোর জন্য কোনো চিহ্ন দেখাতে রাজি হননি। (লূক ২৩:৮, ৯) যিশু তাঁর শক্তি সম্বন্ধে প্রচার করার পরিবর্তে, তিনি যাদের সুস্থ করেছিলেন তাদের সেই সম্বন্ধে কাউকে কিছু বলতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন। (মার্ক ৫:৪৩; ৭:৩৬) তিনি চাননি যে, লোকেরা তাঁর সম্বন্ধে রোমাঞ্চকর কিছু শুনে সিদ্ধান্তে আসুক।—মথি ১২:১৫-১৯.
১৮-২০. (ক) যিশু যেভাবে তাঁর শক্তি ব্যবহার করেছিলেন, তাতে কোন বিষয় প্রভাব ফেলেছিল? (খ) যিশু যেভাবে এক বধির লোককে সুস্থ করেছিলেন, সেই সম্বন্ধে আপনি কেমন মনে করেন?
১৮ এই শক্তিশালী পুরুষ, যিশু, সেই সমস্ত শাসকের থেকে একেবারে আলাদা ছিলেন, যারা অন্যদের চাহিদা ও কষ্টকে উদাসীনভাবে উপেক্ষা করে তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করত। যিশু লোকেদের জন্য চিন্তা করতেন। দুর্দশাগ্রস্ত লোকেদের শুধু একটু দেখেই তিনি এতটা প্রভাবিত হয়েছিলেন যে তিনি তাদের কষ্ট দূর করার জন্য পরিচালিত হয়েছিলেন। (মথি ১৪:১৪) তিনি তাদের অনুভূতি ও চাহিদাকে বিবেচনা করেছিলেন এবং এই কোমল চিন্তা তিনি যেভাবে তাঁর শক্তি ব্যবহার করেছিলেন, তাতে প্রভাব ফেলেছিল। মার্ক ৭:৩১-৩৭ পদে এক মর্মস্পর্শী উদাহরণ পাওয়া যায়।
১৯ এই ঘটনায়, লোকেরা যিশুকে পেয়ে তাঁর কাছে অনেক অসুস্থ রোগীদের নিয়ে এসেছিল এবং তিনি তাদের সবাইকে সুস্থ করেছিলেন। (মথি ১৫:২৯, ৩০) কিন্তু যিশু একজন ব্যক্তিকে বেছে নিয়ে তার দিকে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছিলেন। সেই ব্যক্তি বধির ছিলেন ও কথা বলতে পারতেন না। যিশু হয়তো এই লোকের বিশেষ দুর্বলতা বা অস্বস্তির বিষয়টা বুঝতে পেরেছিলেন। বিবেচনা দেখিয়ে, যিশু এই ব্যক্তিকে জনতার কাছ থেকে দূরে এক নির্জন জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন। এরপর যিশু কী করতে চলেছেন, তা সেই ব্যক্তিকে বোঝানোর জন্য কিছু আকার-ইঙ্গিত করেছিলেন। তিনি “তাহার দুই কর্ণে আপন অঙ্গুলী দিলেন, থুথু ফেলিলেন, ও তাহার জিহ্বা স্পর্শ করিলেন।”c (মার্ক ৭:৩৩) এরপর, যিশু স্বর্গের দিকে তাকিয়ে এক প্রার্থনাপূর্ণ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। এই কাজগুলো সেই ব্যক্তিকে বলেছিল যে, ‘আমি তোমার জন্য যা করতে চলেছি, তা ঈশ্বরের শক্তিতে করছি।’ শেষে, যিশু বলেছিলেন: “খুলিয়া যাউক।” (মার্ক ৭:৩৪) তখন, সেই ব্যক্তির শোনার শক্তি ফিরে এসেছিল এবং তিনি স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পেরেছিলেন।
২০ এটা চিন্তা করা কতই না মর্মস্পর্শী যে, যিশু এমনকি দুর্দশাগ্রস্ত লোকেদের সুস্থ করার জন্য তাঁর ঈশ্বর-দত্ত শক্তি ব্যবহার করার সময়ও, তাদের অনুভূতিগুলোর প্রতি সহানুভূতিপূর্ণ বিবেচনা দেখিয়েছিলেন! এটা জানা কি আশ্বাসদায়ক নয় যে, যিহোবা এইরকম একজন চিন্তাশীল, সুবিবেচক শাসকের হাতে মশীহ রাজ্য অর্পণ করেছেন?
আসন্ন বিষয়গুলোর ইঙ্গিত
২১, ২২. (ক) যিশুর অলৌকিক কাজগুলো কী ইঙ্গিত করেছিল? (খ) যিশুর প্রাকৃতিক শক্তিগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকায় তাঁর রাজ্য শাসনাধীনে আমরা কী আশা করতে পারি?
২১ যিশু পৃথিবীতে যে-শক্তিশালী কাজগুলো করেছিলেন, তা রাজা হিসেবে তাঁর রাজত্বের অধীনে যে আরও মহান আশীর্বাদগুলো আসবে, সেগুলোর পূর্বাভাস ছিল। ঈশ্বরের নতুন জগতে, যিশু আবারও অলৌকিক কাজ করবেন—তবে পৃথিবীব্যাপী! সামনে যে-রোমাঞ্চকর প্রত্যাশাগুলো রয়েছে, সেগুলোর কয়েকটা বিবেচনা করুন।
২২ যিশু পৃথিবীর বাস্তুসংস্থানের মধ্যে নিখুঁত ভারসাম্য ফিরিয়ে আনবেন। মনে করে দেখুন যে, তিনি এক ঝড়কে শান্ত করার মাধ্যমে প্রাকৃতিক শক্তিগুলোর ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ প্রদর্শন করেছিলেন। তাই এটা নিশ্চিত যে, খ্রিস্টের রাজ্য শাসনাধীনে, মানবজাতি ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ভয় পাবে না। যেহেতু যিশু হলেন সুদক্ষ কর্মী, যাঁকে যিহোবা পৃথিবী ও এর সমস্ত জীবিত বস্তু সৃষ্টি করতে ব্যবহার করেছিলেন, তাই তিনি পৃথিবীর গঠন সম্বন্ধে পুরোপুরি জানেন। তিনি জানেন যে, কীভাবে এর সম্পদগুলো সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়। তাঁর শাসনাধীনে, এই পুরো পৃথিবী পরমদেশে পরিণত হবে।—লূক ২৩:৪৩.
২৩. রাজা হিসেবে, যিশু কীভাবে মানবজাতির চাহিদাগুলো পূরণ করবেন?
২৩ মানবজাতির চাহিদাগুলো সম্বন্ধে কী বলা যায়? সামান্য খাবার দিয়ে হাজার হাজার লোককে পেট পুরে খাওয়ানোর ব্যাপারে যিশুর ক্ষমতা আমাদের আশ্বাস দেয় যে, তাঁর শাসন ক্ষুধা থেকে মুক্তি নিয়ে আসবে। বাস্তবিকপক্ষে, প্রচুর খাদ্যের নিরপেক্ষভাবে বন্টন ক্ষুধাকে চিরকালের জন্য শেষ করে দেবে। (গীতসংহিতা ৭২:১৬) অসুস্থতা ও রোগের ওপর তাঁর কর্তৃত্ব আমাদের বলে যে, অসুস্থ, অন্ধ, বধির, বিকলাঙ্গ ও খোঁড়া লোকেরা সুস্থ হয়ে যাবে—সম্পূর্ণভাবে এবং চিরস্থায়ীভাবে। (যিশাইয় ৩৩:২৪; ৩৫:৫, ৬) মৃতদের পুনরুত্থিত করার বিষয়ে তাঁর সামর্থ্য নিশ্চয়তা দেয় যে, স্বর্গীয় রাজা হিসেবে তাঁর ক্ষমতা সেই লক্ষ লক্ষ ব্যক্তিকে পুনরুত্থিত করার শক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করে, যাদেরকে তাঁর পিতা স্মরণ করতে চান।—যোহন ৫:২৮, ২৯.
২৪. যিশুর শক্তি সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা করার সময়, আমাদের কী মনে রাখা উচিত ও কেন?
২৪ যিশুর শক্তি সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা করার সময় আসুন আমরা মনে রাখি যে, এই পুত্র নিখুঁতভাবে তাঁর পিতাকে অনুকরণ করেন। (যোহন ১৪:৯) এভাবে যিশুর শক্তির ব্যবহার আমাদের এই বিষয়ে স্পষ্ট চিত্র দেয় যে, যিহোবা কীভাবে শক্তিকে ব্যবহার করেন। উদাহরণ হিসেবে, যিশু একজন কুষ্ঠরোগীকে যে-কোমল উপায়ে সুস্থ করেছিলেন, সেই বিষয়ে চিন্তা করুন। মমতার দ্বারা চালিত হয়ে, যিশু সেই ব্যক্তিকে স্পর্শ করেছিলেন ও বলেছিলেন: “আমার ইচ্ছা, তুমি শুচীকৃত হও।” (মার্ক ১:৪০-৪২) এইরকম ঘটনাগুলোর মাধ্যমে আসলে যিহোবা বলছেন যে, ‘এভাবেই আমি আমার শক্তি ব্যবহার করি!’ আমাদের সর্বশক্তিমান ঈশ্বর এইরকম প্রেমপূর্ণ উপায়ে তাঁর শক্তি ব্যবহার করেন বলে আপনি কি তাঁর প্রশংসা করতে ও তাঁকে ধন্যবাদ দিতে অনুপ্রাণিত হন না?
a গালীল সমুদ্রে হঠাৎ করে ঝড় ওঠা সাধারণ ব্যাপার ছিল। সমুদ্রের অবস্থান নিচে থাকার কারণে (সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২০০ মিটার নিচে), আশেপাশের এলাকা থেকে সেখানকার বায়ু অনেক বেশি গরম থাকে আর এটাই বায়ুমণ্ডলে অশান্ত অবস্থার সৃষ্টি করে। উত্তরে অবস্থিত, হর্মোণ পর্বত থেকে জর্দন উপত্যকায় প্রবল বায়ু নেমে আসে। এক মুহূর্তের শান্ত অবস্থা হয়তো প্রবল ঝড়ে পরিণত হতে পারে।
b এ ছাড়া, সুসমাচারগুলো কখনও কখনও অনেকগুলো অলৌকিক কাজকে একটা, সাধারণ বর্ণনার মধ্যেও অন্তর্ভুক্ত করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একবার “নগরের সকল লোক” তাঁকে দেখার জন্য এসেছিল এবং তিনি “অনেক” অসুস্থ লোকেদের সুস্থ করেছিলেন।—মার্ক ১:৩২-৩৪.
c থুথু ফেলা সুস্থ করার এক উপায় বা চিহ্ন ছিল, যা যিহুদি ও পরজাতীয়রা উভয়ই স্বীকার করত আর আরোগ্য করায় থুথুর ব্যবহার রব্বিদের লেখায় উল্লেখ করা ছিল। যিশু হয়তো সেই ব্যক্তিকে এটা বোঝানোর জন্য থুথু ফেলেছিলেন যে, সে সুস্থ হতে চলেছে। যাই হোক না কেন, যিশু তাঁর থুথুকে প্রাকৃতিক আরোগ্যকারী মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেননি।
-
-
“খ্রীষ্ট ঈশ্বরেরই পরাক্রম”যিহোবার নিকটবর্তী হোন
-
-
অধ্যায় ৯
“খ্রীষ্ট ঈশ্বরেরই পরাক্রম”
১-৩. (ক) গালীল সমুদ্রে শিষ্যদের কোন আতঙ্কজনক অভিজ্ঞতা হয়েছিল আর যিশু কী করেছিলেন? (খ) কেন যিশুকে উপযুক্তভাবে “খ্রীষ্ট ঈশ্বরেরই পরাক্রম” বলা হয়?
শিষ্যরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তারা নৌকায় চড়ে গালীল সাগর পাড়ি দেওয়ার সময় হঠাৎ করে এক ঝড়ের কবলে পড়ে যায়। কোনো সন্দেহ নেই যে, এর আগেও তারা এই হ্রদে ঝড় হতে দেখেছে—অধিকন্তু, তাদের মধ্যে কয়েক জন অভিজ্ঞ জেলে ছিল।a (মথি ৪:১৮, ১৯) কিন্তু, এটা এক “ভারী ঝড়” ছিল এবং এটা নিমিষের মধ্যে সমুদ্রকে উত্তাল করে দিয়েছিল। এই ব্যক্তিরা মরিয়াভাবে নৌকার হাল ধরে রাখার চেষ্টা করেছিল কিন্তু সেই ঝড় কেবল প্রবলই হচ্ছিল। তরঙ্গ উদ্বেলিত ঢেউগুলো “নৌকায় এমনি আঘাত” করছিল যে তা জলে পূর্ণ হতে শুরু করে। এত হইচই সত্ত্বেও, যিশু নৌকার পিছনের দিকে ঘুমিয়েছিলেন কারণ সারাদিন জনতাকে শিক্ষা দেওয়ার ফলে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। শিষ্যরা তাদের জীবনের ভয়ে, তাঁকে এই বলে জাগিয়ে তুলেছিল: “হে প্রভু, রক্ষা করুন, আমরা মারা পড়িলাম।”—মার্ক ৪:৩৫-৩৮; মথি ৮:২৩-২৫.
২ যিশু ভয় পাননি। সম্পূর্ণ আস্থা নিয়ে, তিনি বাতাস ও সমুদ্রকে ধমক দিয়েছিলেন: “নীরব হও, স্থির হও।” সঙ্গে সঙ্গে বাতাস ও সমুদ্র কথা শুনেছিল—ঝড় থেমে গিয়েছিল, ঢেউ শান্ত হয়ে গিয়েছিল এবং “মহাশান্তি” হয়েছিল। তখন এক অস্বাভাবিক ভয় শিষ্যদের ঘিরে ধরেছিল। তারা ফিসফিস করে একে অন্যকে বলেছিল, “ইনি তবে কে?” সত্যিই তো, কী ধরনের ব্যক্তি বাতাস ও সমুদ্রকে ধমক দিতে পারেন, যেন এক অদম্য বাচ্চাকে শাসন করছেন?—মার্ক ৪:৩৯-৪১; মথি ৮:২৬, ২৭.
৩ কিন্তু যিশু কোনো সাধারণ মানুষ ছিলেন না। যিহোবার শক্তি তাঁর প্রতি এবং তাঁর মাধ্যমে বিভিন্ন অসাধারণ উপায়ে প্রদর্শিত হয়েছিল। অনুপ্রাণিত হয়ে প্রেরিত পৌল উপযুক্তভাবেই তাঁকে “খ্রীষ্ট ঈশ্বরেরই পরাক্রম” হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। (১ করিন্থীয় ১:২৪) কোন কোন উপায়ে ঈশ্বরের শক্তি যিশুতে প্রকাশিত হয়েছিল? আর যিশুর শক্তির ব্যবহার আমাদের জীবনে কোন প্রভাব ফেলতে পারে?
ঈশ্বরের একজাত পুত্রের শক্তি
৪, ৫. (ক) যিহোবা তাঁর একজাত পুত্রকে কোন শক্তি ও কর্তৃত্ব দিয়েছিলেন? (খ) এই পুত্র তাঁর পিতার সৃষ্টি সম্বন্ধীয় উদ্দেশ্যগুলো পূর্ণ করতে কীভাবে সুসজ্জিত ছিলেন?
৪ মানুষ হওয়ার পূর্বে যিশুর যে-শক্তি ছিল, তা বিবেচনা করুন। যিহোবা তাঁর একজাত পুত্রকে সৃষ্টি করার সময় তাঁর “অনন্ত পরাক্রম” ব্যবহার করেছিলেন, যিনি পরে যিশু খ্রিস্ট হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন। (রোমীয় ১:২০; কলসীয় ১:১৫) এরপর, যিহোবা এই পুত্রকে প্রচুর শক্তি ও কর্তৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁকে তাঁর সৃষ্টি সম্বন্ধীয় উদ্দেশ্যগুলো পূর্ণ করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এই পুত্র সম্বন্ধে বাইবেল বলে: “সকলই তাঁহার দ্বারা হইয়াছিল, যাহা হইয়াছে, তাহার কিছুই তাঁহা ব্যতিরেকে হয় নাই।”—যোহন ১:৩.
৫ সেই দায়িত্ব কতটা ব্যাপক ছিল, তা আমরা খুব সামান্যই উপলব্ধি করতে পারি। লক্ষ লক্ষ শক্তিশালী দূত, কোটি কোটি ছায়াপথ সহ ভৌত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এবং বিভিন্ন ধরনের জীবিত বস্তু সহ পৃথিবীকে অস্তিত্বে আনতে কতটা শক্তির প্রয়োজন হয়েছিল, তা কল্পনা করুন। সেই কাজগুলো সম্পাদন করার জন্য একজাত পুত্রের নিয়ন্ত্রণে ছিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে সক্রিয় শক্তি—ঈশ্বরের পবিত্র আত্মা। এই পুত্র সুদক্ষ কর্মী হয়ে অনেক আনন্দ পেয়েছিলেন, যাঁকে যিহোবা অন্য সমস্তকিছু সৃষ্টি করায় ব্যবহার করেছিলেন।—হিতোপদেশ ৮:২২-৩১, NW.
৬. পৃথিবীতে যিশুর মৃত্যু ও পুনরুত্থানের পর, তাঁকে কোন শক্তি ও কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছিল?
৬ একজাত পুত্র কি আরও শক্তি ও কর্তৃত্ব লাভ করতে পেরেছিলেন? যিশু পৃথিবীতে তাঁর মৃত্যু ও পুনরুত্থানের পর বলেছিলেন: “স্বর্গে ও পৃথিবীতে সমস্ত কর্ত্তৃত্ব আমাকে দত্ত হইয়াছে।” (মথি ২৮:১৮) হ্যাঁ, যিশুকে পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে শক্তি ব্যবহার করার ক্ষমতা ও অধিকার দেওয়া হয়েছে। “রাজাদের রাজা ও প্রভুদের প্রভু” হিসেবে, তাঁর পিতার বিরুদ্ধে থাকা দৃশ্য ও অদৃশ্য “সমস্ত আধিপত্য এবং সমস্ত কর্ত্তৃত্ব ও পরাক্রম লোপ” করার ক্ষমতা তাঁকে দেওয়া হয়েছে। (প্রকাশিত বাক্য ১৯:১৬; ১ করিন্থীয় ১৫:২৪-২৬) যিহোবা নিজেকে বাদ দিয়ে যিশুর “অনধীন কিছুই অবশিষ্ট রাখেন নাই।”—ইব্রীয় ২:৮; ১ করিন্থীয় ১৫:২৭.
৭. কেন আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি যে, যিশুকে যিহোবা যে-শক্তি দিয়েছেন, তিনি কখনোই সেটার অপব্যবহার করবেন না?
৭ যিশু তাঁর শক্তির অপব্যবহার করতে পারেন এই ভেবে কি আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার দরকার আছে? অবশ্যই নয়! যিশু তাঁর পিতাকে সত্যিই ভালবাসেন এবং কখনোই এমন কোনো কিছুই করবেন না, যা তাঁকে অখুশি করে। (যোহন ৮:২৯; ১৪:৩১) যিশু ভালভাবেই জানেন যে, যিহোবা কখনোই তাঁর সর্বজনীন শক্তির অপব্যবহার করেন না। যিশু সরাসরি দেখেছেন যে, যিহোবার “প্রতি যাহাদের অন্তঃকরণ একাগ্র, তাহাদের পক্ষে আপনাকে বলবান দেখাইবার জন্য” তিনি সুযোগ খোঁজেন। (২ বংশাবলি ১৬:৯) বাস্তবিকপক্ষে, যিশু মানবজাতির জন্য তাঁর পিতার প্রেমে অংশ নেন, তাই আমরা আস্থা রাখতে পারি যে যিশু সবসময় তাঁর শক্তি উপকারের জন্যই ব্যবহার করবেন। (যোহন ১৩:১) আর যিশু এই ক্ষেত্রে এক নিখুঁত নথি স্থাপন করেছেন। আসুন আমরা বিবেচনা করি যে, পৃথিবীতে থাকাকালীন তাঁর কতটা শক্তি ছিল এবং তিনি কীভাবে তা ব্যবহার করার জন্য পরিচালিত হয়েছিলেন।
“বাক্যে পরাক্রমী”
৮. যিশু তাঁর অভিষেকের পর কী করার শক্তি পেয়েছিলেন এবং তিনি কীভাবে তাঁর শক্তি ব্যবহার করতেন?
৮ স্পষ্টতই, যিশু যখন নাসরতে বড় হচ্ছিলেন, তখন কোনো অলৌকিক কাজ করেননি। কিন্তু সা.কা. ২৯ সালে, প্রায় ৩০ বৎসর বয়সে তিনি বাপ্তিস্ম নেওয়ার পর সেটার পরিবর্তন ঘটে। (লূক ৩:২১-২৩) বাইবেল আমাদের বলে: “ঈশ্বর তাঁহাকে পবিত্র আত্মাতে ও পরাক্রমে অভিষেক করিয়াছিলেন; তিনি হিতকার্য্য করিয়া বেড়াইতেন, এবং দিয়াবল কর্ত্তৃক পীড়িত সকল লোককে সুস্থ করিতেন।” (প্রেরিত ১০:৩৮) ‘হিতকার্য্য করা’—এটা কি ইঙ্গিত করে না যে, যিশু তাঁর শক্তি সঠিকভাবে ব্যবহার করতেন? তাঁর অভিষেকের পর, তিনি “কার্য্যে ও বাক্যে পরাক্রমী ভাববাদী” হয়েছিলেন।—লূক ২৪:১৯.
৯-১১. (ক) যিশু তাঁর বেশির ভাগ শিক্ষা কোথায় দিয়েছিলেন এবং তিনি কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হয়েছিলেন? (খ) যিশু যেভাবে শিক্ষা দিতেন, তা দেখে লোকেরা কেন অবাক হয়ে গিয়েছিল?
৯ যিশু কীভাবে বাক্যে পরাক্রমী ছিলেন? তিনি প্রায়ই খোলা আকাশের নিচে—হ্রদের তীরে, পাহাড়ে ও সেইসঙ্গে রাস্তায় ও বাজারে—শিক্ষা দিতেন। (মার্ক ৬:৫৩-৫৬; লূক ৫:১-৩; ১৩:২৬) যদি তাঁর বাক্যগুলো শ্রোতাদের মধ্যে আগ্রহ না জাগাত, তা হলে তারা চাইলেই সেখান থেকে চলে যেতে পারত। ছাপানো বইপত্র আসার আগের যুগে, উপলব্ধিপূর্ণ শ্রোতাদের তাঁর বাক্যগুলো তাদের মনে ও হৃদয়ে রাখতে হতো। তাই, যিশুর শিক্ষাগুলো এমন হওয়া দরকার ছিল যা, মনোযোগ আকর্ষণ করে, স্পষ্টভাবে বোঝা যায় ও সহজেই মনে রাখা যায়। কিন্তু এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা যিশুর জন্য কোনো সমস্যাই তৈরি করতে পারেনি। উদাহরণ হিসেবে, তাঁর পর্বতে দত্ত উপদেশের কথা বিবেচনা করুন।
১০ সাধারণ কাল ৩১ সালের গোড়ার দিকে এক সকালে, গালীল সমুদ্রের কাছে একটা পাহাড়ে এক দল লোক জড়ো হয়েছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ১০০ থেকে ১১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত যিহূদা ও যিরূশালেম থেকে এসেছিল। অন্যেরা উত্তরে অবস্থিত সোর ও সীদোনের সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা থেকে এসেছিল। অনেক অসুস্থ ব্যক্তি যিশুকে স্পর্শ করার জন্য তাঁর কাছে গিয়েছিল আর তিনি তাদের সবাইকে সুস্থ করেছিলেন। যখন তাদের মধ্যে গুরুতরভাবে অসুস্থ একজন ব্যক্তিও আর বাকি ছিল না, তখন তিনি শিক্ষা দিতে শুরু করেছিলেন। (লূক ৬:১৭-১৯) কিছু সময় পরে তিনি যখন কথা বলা শেষ করেছিলেন, তখন তারা যা শুনেছিল তাতে অবাক হয়ে গিয়েছিল। কেন?
১১ কয়েক বছর পর, সেই উপদেশ শুনেছিলেন এমন একজন ব্যক্তি লিখেছিলেন: “লোকসমূহ তাঁহার উপদেশে চমৎকার জ্ঞান করিল; কারণ তিনি ক্ষমতাপন্ন ব্যক্তির ন্যায় তাহাদিগকে উপদেশ দিতেন।” (মথি ৭:২৮, ২৯) যিশু যে শক্তির সঙ্গে কথা বলেছিলেন, তা তারা উপলব্ধি করতে পেরেছিল। তিনি ঈশ্বরের পক্ষে কথা বলেছিলেন এবং তাঁর শিক্ষা যে ঈশ্বরের বাক্য থেকে, তা দৃঢ়ভাবে তুলে ধরেছিলেন। (যোহন ৭:১৬) যিশুর কথাগুলো স্পষ্ট ছিল, তাঁর পরামর্শগুলো বিশ্বাস উৎপাদন করার মতো ক্ষমতাসম্পন্ন এবং তাঁর যুক্তি অখণ্ডনীয় ছিল। তাঁর বাক্যগুলো বিভিন্ন বিচার্য বিষয়ের কেন্দ্রস্থলে ও সেইসঙ্গে তাঁর শ্রোতাদের হৃদয়ে পৌঁছেছিল। কীভাবে সুখ খুঁজে পাওয়া যায়, কীভাবে প্রার্থনা করতে হয়, কীভাবে ঈশ্বরের রাজ্যের অন্বেষণ করতে হয় এবং কীভাবে এক নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা যায়, সেই বিষয়ে তিনি তাদের শিক্ষা দিয়েছিলেন। (মথি ৫:৩–৭:২৭) তাঁর বাক্যগুলো সেই ব্যক্তিদের হৃদয়কে জাগিয়ে তুলেছিল, যারা সত্য ও ধার্মিকতার জন্য ক্ষুধার্ত ছিল। এইরকম ব্যক্তিরা নিজেদের “অস্বীকার” করতে এবং তাঁকে অনুসরণ করার জন্য সমস্তকিছু ত্যাগ করতে ইচ্ছুক ছিল। (মথি ১৬:২৪; লূক ৫:১০, ১১) যিশুর বাক্যগুলোর শক্তি সম্বন্ধে কী এক প্রামাণিক সাক্ষ্য!
‘কার্য্যে পরাক্রমী’
১২, ১৩. কোন অর্থে যিশু ‘কার্য্যে পরাক্রমী’ ছিলেন এবং তাঁর অলৌকিক কাজগুলোর মধ্যে কোন বৈচিত্র্য ছিল?
১২ যিশু ‘কার্য্যেও পরাক্রমী’ ছিলেন। (লূক ২৪:১৯) সুসমাচারগুলো তাঁর দ্বারা সম্পাদিত ৩০টা নির্দিষ্ট অলৌকিক কাজের কথা বর্ণনা করে—যেগুলোর সমস্তই ‘প্রভুর [“যিহোবার,” NW] শক্তিতে’ করা হয়েছিল।b (লূক ৫:১৭) যিশুর অলৌকিক কাজগুলো হাজার হাজার লোকের জীবনকে প্রভাবিত করেছিল। শুধুমাত্র দুটো অলৌকিক কাজ—“স্ত্রী ও শিশু ছাড়া” ৫,০০০ ও পরে ৪,০০০ পুরুষকে খাওয়ানো—সবমিলিয়ে সম্ভবত প্রায় ২০,০০০ লোককে অন্তর্ভুক্ত করেছিল!—মথি ১৪:১৩-২১; ১৫:৩২-৩৮.
‘তাঁহারা যীশুকে দেখিতে পাইলেন, তিনি সমুদ্রের উপর দিয়া হাঁটিতেছেন’
১৩ যিশুর অলৌকিক কাজগুলোর মধ্যে ব্যাপক বৈচিত্র্য ছিল। মন্দ দূতেদের ওপর তাঁর কর্তৃত্ব ছিল, তিনি অনায়াসে তাদেরকে বের করে দিতে পারতেন। (লূক ৯:৩৭-৪৩) ভৌত উপাদানগুলোর ওপরও তাঁর ক্ষমতা ছিল, যেমন জলকে দ্রাক্ষারসে পরিণত করা। (যোহন ২:১-১১) শিষ্যদের অবাক করে দিয়ে, তিনি বায়ু প্রবাহিত গালীল সমুদ্রের উপর দিয়ে হেঁটে গিয়েছিলেন। (যোহন ৬:১৮, ১৯) রোগের ওপর তাঁর কর্তৃত্ব ছিল, তিনি শারীরিক ত্রুটি, দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা এবং জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ এমন রোগব্যাধি সারিয়ে তুলেছিলেন। (মার্ক ৩:১-৫; যোহন ৪:৪৬-৫৪) তিনি সুস্থ করার এই কাজগুলো বিভিন্ন উপায়ে করেছিলেন। কেউ কেউ অনেক দূর থেকে সুস্থ হয়েছিল আর অন্যেরা যিশুর সামান্য স্পর্শে সুস্থ হয়েছিল। (মথি ৮:২, ৩, ৫-১৩) কেউ কেউ সঙ্গে সঙ্গে সুস্থ হয়ে গিয়েছিল আবার অন্যেরা ধীরে ধীরে।—মার্ক ৮:২২-২৫; লূক ৮:৪৩, ৪৪.
১৪. কোন পরিস্থিতিগুলোতে যিশু দেখিয়েছিলেন যে মৃত্যু থেকে ফিরিয়ে আনার শক্তি তাঁর রয়েছে?
১৪ লক্ষণীয় বিষয়টি হল, মৃত্যু থেকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার শক্তি যিশুর ছিল। লিপিবদ্ধ তিনটে ঘটনায় তিনি মৃতদের উত্থাপিত করেছিলেন, ১২ বছরের এক মেয়েকে তার বাবামার কাছে, একমাত্র সন্তানকে তার বিধবা মায়ের কাছে এবং এক প্রিয় ভাইকে তার বোনদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। (লূক ৭:১১-১৫; ৮:৪৯-৫৬; যোহন ১১:৩৮-৪৪) কোনো পরিস্থিতিকেই কঠিন বলে মনে হয়নি। তিনি ১২ বছরের এক মেয়েকে মারা যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই তার মৃত্যুশয্যা থেকে উত্থাপিত করেছিলেন। তিনি বিধবার ছেলেকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার খাট থেকে পুনরুত্থিত করেছিলেন আর কোনো সন্দেহ নেই যে, ছেলেটি যেদিন মারা গিয়েছিল সেদিনই তা করা হয়েছিল। আর লাসার মারা যাওয়ার চার দিন পরে তিনি তাঁকে কবর থেকে পুনরুত্থিত করেছিলেন।
নিঃস্বার্থভাবে, দায়িত্ব এবং বিবেচনার সঙ্গে শক্তির ব্যবহার
১৫, ১৬. কোন প্রমাণ রয়েছে যে, যিশু নিঃস্বার্থভাবে তাঁর শক্তি ব্যবহার করতেন?
১৫ যিশুর ক্ষমতা যদি একজন অসিদ্ধ শাসকের হাতে দেওয়া হতো, তা হলে এর অপব্যবহার হওয়ার সম্ভাবনার কথা কি আপনি কল্পনা করতে পারেন? কিন্তু যিশু নিষ্পাপ ছিলেন। (১ পিতর ২:২২) তিনি স্বার্থপরতা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং লোভের দ্বারা কলুষিত হওয়াকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, যেগুলো অসিদ্ধ মানুষদের তাদের ক্ষমতাকে অন্যদের ক্ষতি করার জন্য ব্যবহার করতে পরিচালিত করে।
১৬ যিশু তাঁর শক্তি নিঃস্বার্থভাবে ব্যবহার করতেন, এটাকে কখনও ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য কাজে লাগাননি। তিনি যখন ক্ষুধার্ত ছিলেন, তখন নিজের জন্য পাথরকে রুটি বানাতে রাজি হননি। (মথি ৪:১-৪) তাঁর অল্প জিনিসপত্র প্রমাণ করেছিল যে, বস্তুগত লাভের জন্য তিনি তাঁর শক্তি ব্যবহার করেননি। (মথি ৮:২০) আরও প্রমাণ রয়েছে যে তাঁর শক্তিশালী কাজগুলো নিঃস্বার্থ প্রেরণা থেকে এসেছিল। অলৌকিক কাজগুলো করার সময় তাঁকে কিছু ত্যাগ করতে হতো। অসুস্থদের সুস্থ করার সময় তাঁর মধ্যে থেকে শক্তি বেরিয়ে যেত। এই শক্তি বেরিয়ে যাওয়ার সময় তিনি বুঝতে পারতেন, এমনকি শুধুমাত্র একটা আরোগ্য করা হলেও। (মার্ক ৫:২৫-৩৪) তবুও, তিনি সমস্ত লোককে তাঁকে স্পর্শ করতে দিতেন আর তারা সুস্থ হতো। (লূক ৬:১৯) কত নিঃস্বার্থ মনোভাব!
১৭. যিশু কীভাবে দেখিয়েছিলেন যে তিনি দায়িত্বের সঙ্গে তাঁর শক্তি ব্যবহার করতেন?
১৭ যিশু দায়িত্বের সঙ্গে তাঁর শক্তি ব্যবহার করতেন। তিনি কখনোই শুধু নিজেকে জাহির করার জন্য বা অযথা লোক দেখানোর জন্য অলৌকিক কাজগুলো করেননি। (মথি ৪:৫-৭) তিনি শুধুমাত্র হেরোদের ভুল কৌতূহল মেটানোর জন্য কোনো চিহ্ন দেখাতে রাজি হননি। (লূক ২৩:৮, ৯) যিশু তাঁর শক্তি সম্বন্ধে প্রচার করার পরিবর্তে, তিনি যাদের সুস্থ করেছিলেন তাদের সেই সম্বন্ধে কাউকে কিছু বলতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন। (মার্ক ৫:৪৩; ৭:৩৬) তিনি চাননি যে, লোকেরা তাঁর সম্বন্ধে রোমাঞ্চকর কিছু শুনে সিদ্ধান্তে আসুক।—মথি ১২:১৫-১৯.
১৮-২০. (ক) যিশু যেভাবে তাঁর শক্তি ব্যবহার করেছিলেন, তাতে কোন বিষয় প্রভাব ফেলেছিল? (খ) যিশু যেভাবে এক বধির লোককে সুস্থ করেছিলেন, সেই সম্বন্ধে আপনি কেমন মনে করেন?
১৮ এই শক্তিশালী পুরুষ, যিশু, সেই সমস্ত শাসকের থেকে একেবারে আলাদা ছিলেন, যারা অন্যদের চাহিদা ও কষ্টকে উদাসীনভাবে উপেক্ষা করে তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করত। যিশু লোকেদের জন্য চিন্তা করতেন। দুর্দশাগ্রস্ত লোকেদের শুধু একটু দেখেই তিনি এতটা প্রভাবিত হয়েছিলেন যে তিনি তাদের কষ্ট দূর করার জন্য পরিচালিত হয়েছিলেন। (মথি ১৪:১৪) তিনি তাদের অনুভূতি ও চাহিদাকে বিবেচনা করেছিলেন এবং এই কোমল চিন্তা তিনি যেভাবে তাঁর শক্তি ব্যবহার করেছিলেন, তাতে প্রভাব ফেলেছিল। মার্ক ৭:৩১-৩৭ পদে এক মর্মস্পর্শী উদাহরণ পাওয়া যায়।
১৯ এই ঘটনায়, লোকেরা যিশুকে পেয়ে তাঁর কাছে অনেক অসুস্থ রোগীদের নিয়ে এসেছিল এবং তিনি তাদের সবাইকে সুস্থ করেছিলেন। (মথি ১৫:২৯, ৩০) কিন্তু যিশু একজন ব্যক্তিকে বেছে নিয়ে তার দিকে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছিলেন। সেই ব্যক্তি বধির ছিলেন ও কথা বলতে পারতেন না। যিশু হয়তো এই লোকের বিশেষ দুর্বলতা বা অস্বস্তির বিষয়টা বুঝতে পেরেছিলেন। বিবেচনা দেখিয়ে, যিশু এই ব্যক্তিকে জনতার কাছ থেকে দূরে এক নির্জন জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন। এরপর যিশু কী করতে চলেছেন, তা সেই ব্যক্তিকে বোঝানোর জন্য কিছু আকার-ইঙ্গিত করেছিলেন। তিনি “তাহার দুই কর্ণে আপন অঙ্গুলী দিলেন, থুথু ফেলিলেন, ও তাহার জিহ্বা স্পর্শ করিলেন।”c (মার্ক ৭:৩৩) এরপর, যিশু স্বর্গের দিকে তাকিয়ে এক প্রার্থনাপূর্ণ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। এই কাজগুলো সেই ব্যক্তিকে বলেছিল যে, ‘আমি তোমার জন্য যা করতে চলেছি, তা ঈশ্বরের শক্তিতে করছি।’ শেষে, যিশু বলেছিলেন: “খুলিয়া যাউক।” (মার্ক ৭:৩৪) তখন, সেই ব্যক্তির শোনার শক্তি ফিরে এসেছিল এবং তিনি স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পেরেছিলেন।
২০ এটা চিন্তা করা কতই না মর্মস্পর্শী যে, যিশু এমনকি দুর্দশাগ্রস্ত লোকেদের সুস্থ করার জন্য তাঁর ঈশ্বর-দত্ত শক্তি ব্যবহার করার সময়ও, তাদের অনুভূতিগুলোর প্রতি সহানুভূতিপূর্ণ বিবেচনা দেখিয়েছিলেন! এটা জানা কি আশ্বাসদায়ক নয় যে, যিহোবা এইরকম একজন চিন্তাশীল, সুবিবেচক শাসকের হাতে মশীহ রাজ্য অর্পণ করেছেন?
আসন্ন বিষয়গুলোর ইঙ্গিত
২১, ২২. (ক) যিশুর অলৌকিক কাজগুলো কী ইঙ্গিত করেছিল? (খ) যিশুর প্রাকৃতিক শক্তিগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকায় তাঁর রাজ্য শাসনাধীনে আমরা কী আশা করতে পারি?
২১ যিশু পৃথিবীতে যে-শক্তিশালী কাজগুলো করেছিলেন, তা রাজা হিসেবে তাঁর রাজত্বের অধীনে যে আরও মহান আশীর্বাদগুলো আসবে, সেগুলোর পূর্বাভাস ছিল। ঈশ্বরের নতুন জগতে, যিশু আবারও অলৌকিক কাজ করবেন—তবে পৃথিবীব্যাপী! সামনে যে-রোমাঞ্চকর প্রত্যাশাগুলো রয়েছে, সেগুলোর কয়েকটা বিবেচনা করুন।
২২ যিশু পৃথিবীর বাস্তুসংস্থানের মধ্যে নিখুঁত ভারসাম্য ফিরিয়ে আনবেন। মনে করে দেখুন যে, তিনি এক ঝড়কে শান্ত করার মাধ্যমে প্রাকৃতিক শক্তিগুলোর ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ প্রদর্শন করেছিলেন। তাই এটা নিশ্চিত যে, খ্রিস্টের রাজ্য শাসনাধীনে, মানবজাতি ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ভয় পাবে না। যেহেতু যিশু হলেন সুদক্ষ কর্মী, যাঁকে যিহোবা পৃথিবী ও এর সমস্ত জীবিত বস্তু সৃষ্টি করতে ব্যবহার করেছিলেন, তাই তিনি পৃথিবীর গঠন সম্বন্ধে পুরোপুরি জানেন। তিনি জানেন যে, কীভাবে এর সম্পদগুলো সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়। তাঁর শাসনাধীনে, এই পুরো পৃথিবী পরমদেশে পরিণত হবে।—লূক ২৩:৪৩.
২৩. রাজা হিসেবে, যিশু কীভাবে মানবজাতির চাহিদাগুলো পূরণ করবেন?
২৩ মানবজাতির চাহিদাগুলো সম্বন্ধে কী বলা যায়? সামান্য খাবার দিয়ে হাজার হাজার লোককে পেট পুরে খাওয়ানোর ব্যাপারে যিশুর ক্ষমতা আমাদের আশ্বাস দেয় যে, তাঁর শাসন ক্ষুধা থেকে মুক্তি নিয়ে আসবে। বাস্তবিকপক্ষে, প্রচুর খাদ্যের নিরপেক্ষভাবে বন্টন ক্ষুধাকে চিরকালের জন্য শেষ করে দেবে। (গীতসংহিতা ৭২:১৬) অসুস্থতা ও রোগের ওপর তাঁর কর্তৃত্ব আমাদের বলে যে, অসুস্থ, অন্ধ, বধির, বিকলাঙ্গ ও খোঁড়া লোকেরা সুস্থ হয়ে যাবে—সম্পূর্ণভাবে এবং চিরস্থায়ীভাবে। (যিশাইয় ৩৩:২৪; ৩৫:৫, ৬) মৃতদের পুনরুত্থিত করার বিষয়ে তাঁর সামর্থ্য নিশ্চয়তা দেয় যে, স্বর্গীয় রাজা হিসেবে তাঁর ক্ষমতা সেই লক্ষ লক্ষ ব্যক্তিকে পুনরুত্থিত করার শক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করে, যাদেরকে তাঁর পিতা স্মরণ করতে চান।—যোহন ৫:২৮, ২৯.
২৪. যিশুর শক্তি সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা করার সময়, আমাদের কী মনে রাখা উচিত ও কেন?
২৪ যিশুর শক্তি সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা করার সময় আসুন আমরা মনে রাখি যে, এই পুত্র নিখুঁতভাবে তাঁর পিতাকে অনুকরণ করেন। (যোহন ১৪:৯) এভাবে যিশুর শক্তির ব্যবহার আমাদের এই বিষয়ে স্পষ্ট চিত্র দেয় যে, যিহোবা কীভাবে শক্তিকে ব্যবহার করেন। উদাহরণ হিসেবে, যিশু একজন কুষ্ঠরোগীকে যে-কোমল উপায়ে সুস্থ করেছিলেন, সেই বিষয়ে চিন্তা করুন। মমতার দ্বারা চালিত হয়ে, যিশু সেই ব্যক্তিকে স্পর্শ করেছিলেন ও বলেছিলেন: “আমার ইচ্ছা, তুমি শুচীকৃত হও।” (মার্ক ১:৪০-৪২) এইরকম ঘটনাগুলোর মাধ্যমে আসলে যিহোবা বলছেন যে, ‘এভাবেই আমি আমার শক্তি ব্যবহার করি!’ আমাদের সর্বশক্তিমান ঈশ্বর এইরকম প্রেমপূর্ণ উপায়ে তাঁর শক্তি ব্যবহার করেন বলে আপনি কি তাঁর প্রশংসা করতে ও তাঁকে ধন্যবাদ দিতে অনুপ্রাণিত হন না?
a গালীল সমুদ্রে হঠাৎ করে ঝড় ওঠা সাধারণ ব্যাপার ছিল। সমুদ্রের অবস্থান নিচে থাকার কারণে (সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২০০ মিটার নিচে), আশেপাশের এলাকা থেকে সেখানকার বায়ু অনেক বেশি গরম থাকে আর এটাই বায়ুমণ্ডলে অশান্ত অবস্থার সৃষ্টি করে। উত্তরে অবস্থিত, হর্মোণ পর্বত থেকে জর্দন উপত্যকায় প্রবল বায়ু নেমে আসে। এক মুহূর্তের শান্ত অবস্থা হয়তো প্রবল ঝড়ে পরিণত হতে পারে।
b এ ছাড়া, সুসমাচারগুলো কখনও কখনও অনেকগুলো অলৌকিক কাজকে একটা, সাধারণ বর্ণনার মধ্যেও অন্তর্ভুক্ত করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একবার “নগরের সকল লোক” তাঁকে দেখার জন্য এসেছিল এবং তিনি “অনেক” অসুস্থ লোকেদের সুস্থ করেছিলেন।—মার্ক ১:৩২-৩৪.
c থুথু ফেলা সুস্থ করার এক উপায় বা চিহ্ন ছিল, যা যিহুদি ও পরজাতীয়রা উভয়ই স্বীকার করত আর আরোগ্য করায় থুথুর ব্যবহার রব্বিদের লেখায় উল্লেখ করা ছিল। যিশু হয়তো সেই ব্যক্তিকে এটা বোঝানোর জন্য থুথু ফেলেছিলেন যে, সে সুস্থ হতে চলেছে। যাই হোক না কেন, যিশু তাঁর থুথুকে প্রাকৃতিক আরোগ্যকারী মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেননি।
-
-
“খ্রীষ্ট ঈশ্বরেরই পরাক্রম”যিহোবার নিকটবর্তী হোন
-
-
১৭. যিশু কীভাবে দেখিয়েছিলেন যে তিনি দায়িত্বের সঙ্গে তাঁর শক্তি ব্যবহার করতেন?১৮-২০. (ক) যিশু যেভাবে তাঁর শক্তি ব্যবহার করেছিলেন, তাতে কোন বিষয় প্রভাব ফেলেছিল? (খ) যিশু যেভাবে এক বধির লোককে সুস্থ করেছিলেন, সেই সম্বন্ধে আপনি কেমন মনে করেন?
-