তুখিক—এক আস্থাবান সহদাস
বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তুখিক প্রেরিত পৌলের সঙ্গে ভ্রমণ করেছিলেন ও তার বার্তাবাহক হিসাবে কাজ করেছিলেন। তিনি এমন এক নির্ভরযোগ্য দূত ছিলেন যার উপর বিশ্বাস করে অর্থ ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব অর্পণ করা যেত। যেহেতু শাস্ত্র তার আস্থাযোগ্যতার উপর আলোকপাত করে—এমন এক গুণ যা সকল খ্রীষ্টানদের জন্য অত্যাবশ্যক—তাই, সম্ভবত আপনি তার সম্বন্ধে আরও কিছু জানতে চাইবেন।
পৌল তুখিককে “প্রভুতে প্রিয় ভ্রাতা, বিশ্বস্ত পরিচারক ও সহদাস” হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। (কলসীয় ৪:৭) কেন প্রেরিত তাকে এই দৃষ্টিতে দেখেছিলেন?
যিরূশালেমে ত্রাণ কাজ
প্রায় সা.কা. ৫৫ সালে যিহূদীয়ার খ্রীষ্টানদের মধ্যে বস্তুগত অভাব দেখা দিয়েছিল। তাদের সাহায্য করার জন্য ইউরোপ ও এশিয়া মাইনরের মণ্ডলীগুলির সহায়তায় পৌল দান সংগ্রহের কাজ সংগঠিত করেছিলেন। এশিয়া প্রদেশের তুখিক, এই ত্রাণ কাজে এক বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন।
এই দান কিভাবে ব্যবহৃত হবে সেই বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়ার পর পৌল প্রস্তাব করেছিলেন যে তা নিয়ে যাওয়ার জন্য আস্থাযোগ্য ব্যক্তিদের যিরূশালেমে পাঠানো হবে অথবা তারা তার সঙ্গে সেখানে যাবেন। (১ করিন্থীয় ১৬:১-৪) যখন তিনি গ্রীস থেকে যিরূশালেমে যাওয়ার জন্য দীর্ঘ যাত্রা করেছিলেন, বিভিন্ন ব্যক্তিরা তার সঙ্গে গিয়েছিলেন যাদের মধ্যে স্পষ্টতই তুখিক ছিলেন একজন। (প্রেরিত ২০:৪) এইধরনের বৃহৎ সংখ্যক সঙ্গীদের হয়ত প্রয়োজন ছিল কারণ তাদের উপর বিভিন্ন মণ্ডলীর দেওয়া অর্থ নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল। নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তা হয়ত একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল কারণ পথিমধ্যে দস্যুরা নিরাপদ যাত্রার পক্ষে ভীতিজনক ছিল।—২ করিন্থীয় ১১:২৬.
যেহেতু আরিষ্টার্খ ও ত্রফিম যিরূশালেমের পথে পৌলের সঙ্গী হয়েছিলেন, কিছুজন মনে করেন যে সম্ভবত তুখিক ও অন্যান্যেরাও তাই করেছিলেন। (প্রেরিত ২১:২৯; ২৪:১৭; ২৭:১, ২) যেহেতু তুখিক এই ত্রাণ কাজে জড়িত ছিলেন, তিনি সেই বিভিন্ন প্রস্তাবিত ভাইদের মধ্যে একজন ‘ভ্রাতা’ ছিলেন, যিনি গ্রীসে তীতের সঙ্গে দান সংগ্রহকে সংগঠিত করতে কাজ করেছিলেন এবং যিনি “সেই অনুগ্রহ-কার্য্য সম্বন্ধে [পৌলের] সহচর হইবার জন্য মণ্ডলীগণ কর্ত্তৃক নির্ব্বাচিতও হইয়াছেন।” (২ করিন্থীয় ৮:১৮, ১৯; ১২:১৮) প্রথম যে কার্যভার তুখিক সম্পন্ন করেছিলেন সেটি যদি দায়িত্বপূর্ণ কাজ হয়ে থাকে তাহলে, দ্বিতীয়টিও তার চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না।
রোম থেকে কলসী
পাঁচ অথবা ছয় বছর পরে (সা.কা. ৬০-৬১ সাল) পৌল রোমে তার প্রথম কারাবাস থেকে মুক্তি পাওয়ার আশা করছিলেন। ঘর ছেড়ে শত শত কিলোমিটার দূরে তুখিক তার সঙ্গে ছিলেন। তুখিক এখন আবার এশিয়ায় ফিরে যাচ্ছেন। এটি পৌলকে সেই এলাকায় অবস্থিত খ্রীষ্টীয় মণ্ডলীগুলিতে চিঠি পাঠাতে ও ফিলীমনের পলাতক দাস ওনীষিমকে কলসীতে ফেরৎ পাঠাতে সক্ষম করেছিল। তুখিক ও ওনীষিম অন্ততপক্ষে তিনটি চিঠি নিয়ে এসেছিলেন যেগুলি এখন বাইবেলের প্রামাণ্য অংশের অন্তর্গত—একটি ইফিষীয়দের প্রতি, একটি কলসীয়দের প্রতি ও একটি ফিলীমনের প্রতি। লায়দিকেয়া মণ্ডলীকেও হয়ত একটি চিঠি দেওয়া হয়েছিল, যে শহরটি কলসী থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছিল।—ইফিষীয় ৬:২১; কলসীয় ৪:৭-৯, ১৬, ফিলিমন ১০-১২.
তুখিক কেবল ডাক বাহকই ছিলেন না। তিনি একজন আস্থাবান ব্যক্তিগত বার্তাবাহক ছিলেন কারণ পৌল লিখেছিলেন: “প্রভুতে প্রিয় ভ্রাতা, বিশ্বস্ত পরিচারক ও সহদাস যে তুখিক, তিনি তোমাদিগকে আমার সমস্ত বিষয় জানাইবেন। তোমাদের কাছে তাঁহাকে এই কারণ পাঠাইলাম, যেন তোমরা জানিতে পার যে, আমরা কেমন আছি, এবং তিনি যেন তোমাদের হৃদয়কে আশ্বাস দেন।”—কলসীয় ৪:৭, ৮.
পণ্ডিত ই. রানডল্ফ রিচার্ডস উল্লেখ করেছিলেন যে একজন পত্রবাহক “প্রায়ই লিখিত যোগাযোগ ছাড়াও লেখক ও প্রাপকের মধ্যে এক ব্যক্তিগত যোগাযোগ রূপে কাজ করতেন। . . . কেন এক আস্থাযোগ্য বাহকের প্রয়োজন হত তার [একটি কারণ] ছিল [যে] তিনি প্রায়ই কিছু অতিরিক্ত তথ্য বহন করতেন। একটি চিঠি হয়ত পরিস্থিতিকে সংক্ষেপে বর্ণনা করতে পারে, যেখানে প্রায়ই লেখকের মূল্যায়ন সম্বন্ধে থাকে কিন্তু বাহকের কাছ থেকে প্রত্যাশা করা হত যে তিনি প্রাপককে বিস্তারিতভাবে তা ব্যাখ্যা করবেন।” যদিও কিছু শিক্ষা ও জরুরি বিষয় একটি চিঠির মাধ্যমে লেনদেন করা যেত কিন্তু অন্যান্য বিষয়গুলি একজন আস্থাবান বার্তাবাহকের দ্বারা মৌখিকভাবে জানানো হত।
পৌল কিভাবে দিন কাটাচ্ছিলেন সেই সম্বন্ধে ইফিষীয়, কলসীয় ও ফিলীমনের প্রতি লিখিত চিঠিগুলি খুব অল্পই বলে। তাই তুখিককে ব্যক্তিগত তথ্য সরবরাহ করতে হয়েছিল, রোমে পৌলের অবস্থা সম্বন্ধে বর্ণনা করতে হয়েছিল আর মণ্ডলীর পরিস্থিতি ভালভাবে বুঝতে হয়েছিল যাতে করে তিনি তাদের উৎসাহিত করতে পারেন। এই প্রকার বার্তা ও দায়িত্ব কেবল তাদের উপরই অর্পণ করা হত যাদের উপর নির্ভর করা যেত যে তারা বিশ্বস্তভাবে প্রেরকের প্রতিনিধিত্ব করবেন। তুখিক এইধরনের এক ব্যক্তি ছিলেন।
দূরবর্তী কার্যভারে তত্ত্বাবধান করা
রোমে গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার পর পৌল তুখিককে অথবা আর্ত্তিমাকে ক্রীতী দ্বীপে তীতের কাছে পাঠাবেন বলে চিন্তা করেছিলেন। (তীত ১:৫; ৩:১২) রোমে পৌলের দ্বিতীয় কারাবাসের সময় (সম্ভবত প্রায় সা.কা. ৬৫ সাল) প্রেরিত আবার তুখিককে ইফিষে পাঠিয়েছিলেন, সম্ভবত তীমথিয়ের স্থান নিতে যিনি সেই সময় পৌলের সঙ্গে থাকার জন্য এসেছিলেন।—২ তীমথিয় ৪:৯, ১২.
সেই সময়ে তুখিক ক্রীতী ও ইফিষ দুটি স্থানেই গিয়েছিলেন কি না তা স্পষ্ট নয়। তৎসত্ত্বেও এইধরনের উদ্ধৃতিগুলি জানায় যে তিনি প্রেরিতের পরিচর্যার শেষ বছরগুলি পর্যন্ত পৌলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসাবে থেকেছিলেন। পৌল যেহেতু তীমথিয় এবং তীতের জায়গায় তাকে দায়িত্বপূর্ণ ও হয়ত কঠিন কার্যাদি সাধনের জন্য পাঠানোর কথা চিন্তা করছিলেন, সুতরাং স্পষ্টতই তুখিক একজন পরিপক্ব খ্রীষ্টান অধ্যক্ষে পরিণত হয়েছিলেন। (১ তীমথিয় ১:৩; তীত ১:১০-১৩ পদগুলির সাথে তুলনা করুন।) ভ্রমণ করার জন্য তার ইচ্ছুক মনোভাব ও দূরবর্তী কার্যভারের জন্য ব্যবহৃত হতে চাওয়া তাকে পৌল ও সমগ্র খ্রীষ্টীয় মণ্ডলীর জন্য ব্যবহারিক করে তুলেছিল।
আজকে আত্ম-ত্যাগী খ্রীষ্টানেরা স্বেচ্ছায় যিহোবার সাক্ষীদের স্থানীয় মণ্ডলীতে ঈশ্বরের সেবা করেন অথবা রাজ্যের আগ্রহকে বৃদ্ধির জন্য নিজেদের অন্য যে কোন স্থানে প্রাপ্তিসাধ্য করেন। হাজার হাজার ব্যক্তিরা আনন্দের সঙ্গে মিশনারি, ভ্রমণ অধ্যক্ষ, নির্মাণ প্রকল্পে আন্তর্জাতিক সেবক হিসাবে ওয়াচ টাওয়ার সোসাইটির বিশ্ব প্রধান কার্যালয়ে অথবা এর কোন একটি শাখায় কার্যভার গ্রহণ করেছেন। তুখিকের মত তারা অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন না কিন্তু তারা পরিশ্রমী ‘বিশ্বস্ত পরিচারক’ যারা ঈশ্বরের প্রিয়পাত্র ও আস্থাযোগ্য “প্রভুতে সহদাস” হিসাবে অন্যান্য খ্রীষ্টানদের দ্বারা সমাদৃত হন।