তাদের বিশ্বাস অনুকরণ করুন
হতাশাগুলো সত্ত্বেও তিনি ধৈর্য ধরেছিলেন
শমূয়েল শীলোতে লোকেদের শোক অনুভব করতে পেরেছিলেন। মনে হয়েছিল যেন লোকেদের চোখের জলে নগরটা ভেসে যাচ্ছিল। বাবা, স্বামী, ছেলে ও ভাইয়েরা যে আর বাড়ি ফিরবে না, সেই সংবাদে কতজন স্ত্রী ও সন্তান কান্নাকাটি এবং শোক করেছিল? আমরা শুধু এটাই জানি যে, অল্প কিছুদিন আগে আরেকটা যুদ্ধে ৪,০০০ সৈন্য হারানোর পর, ইস্রায়েল পলেষ্টীয়দের কাছে সাংঘাতিকভাবে পরাজিত হয়ে প্রায় ৩০,০০০ সৈন্য হারিয়েছিল।—১ শমূয়েল ৪:১, ২, ১০.
সেটা ধারাবাহিকভাবে ঘটে যাওয়া দুঃখজনক ঘটনাগুলোর এক অংশ মাত্র ছিল। মহাযাজক এলির দুজন দুষ্ট ছেলে ছিল হফ্নি ও পীনহস, যারা পবিত্র নিয়ম-সিন্দুক নিয়ে শীলো থেকে বের হয়েছিল। সাধারণত আবাসের—তাঁবুর মতো এক মন্দিরের—পবিত্র কক্ষে রাখা এই মূল্যবান সিন্দুক ঈশ্বরের উপস্থিতির এক চিহ্ন ছিল। এটা এক রক্ষাকবচের মতো কাজ করবে এবং তাদের জন্য বিজয় নিয়ে আসবে, মূর্খের মতো এরকম মনে করে লোকেরা এই সিন্দুক যুদ্ধে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পলেষ্টীয়রা হফ্নি ও পীনহসকে হত্যা করে সিন্দুকটাকে হস্তগত করেছিল।—১ শমূয়েল ৪:৩-১১.
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সিন্দুকের উপস্থিতির দ্বারা শীলোর আবাসকে সম্মানিত করা হতো। এখন সেটা চলে গিয়েছে। এই সংবাদ শুনে, ৯৮ বছর বয়সি এলি তার চেয়ার থেকে পিছন দিকে পড়ে মারা গিয়েছিলেন। তার পুত্রবধূ, যিনি সেই দিনেই বিধবা হয়েছিলেন, তিনি সন্তান প্রসব করে মারা গিয়েছিলেন। মারা যাওয়ার আগে, তিনি বলেছিলেন: “ইস্রায়েল হইতে প্রতাপ গেল।” বস্তুতপক্ষে, শীলো আর সেইরকম থাকল না।—১ শমূয়েল ৪:১২-২২.
কীভাবে শমূয়েল এই প্রচণ্ড হতাশাগুলোর সঙ্গে মোকাবিলা করবেন? যে-লোকেরা যিহোবার সুরক্ষা ও অনুগ্রহ হারিয়েছিল, তাদের সাহায্য করার প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে তার বিশ্বাস কি অটল থাকবে? আজকে আমরা সকলেই মাঝে মাঝে সেই কষ্ট ও হতাশাগুলোর মুখোমুখি হতে পারি, যেগুলো আমাদের বিশ্বাসকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে ফেলে, তাই আসুন দেখি যে, শমূয়েলের কাছ থেকে আমরা কী শিখতে পারি।
তিনি ‘ধার্ম্মিকতার অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন’
বাইবেলের বিবরণ এই পর্যায়ে শমূয়েলের ওপর মনোযোগ সরিয়ে নিয়ে পবিত্র সিন্দুকের ওপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে ও আমাদেরকে দেখায় যে, এটা নেওয়ার জন্য পলেষ্টীয়রা কীভাবে কষ্টভোগ করেছিল এবং তারা এটা ফিরিয়ে আনার জন্য বাধ্য হয়েছিল। বাইবেল যখন আবারও শমূয়েলের বিষয়ে উল্লেখ করে, ততদিনে প্রায় ২০ বছর অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে। (১ শমূয়েল ৭:২) এই বছরগুলো তিনি কীভাবে কাটিয়েছিলেন? বাইবেল আমাদের তা বলে।
আমরা পড়ি যে, এই সময়কাল শুরু হওয়ার আগে “সমস্ত ইস্রায়েলের কাছে শমূয়েলের বাক্য উপস্থিত হইত।” (১ শমূয়েল ৩:২১) বিবরণ প্রকাশ করে যে, সেই সময়কাল শেষ হওয়ার পর শমূয়েল ইস্রায়েলের তিনটে নগরকে একটা বিভাগ হিসেবে গঠন করে প্রতি বছর সেটা পরিদর্শন করতেন এবং বিভিন্ন মতবিরোধ ও প্রশ্নের সমাধান করতেন। এরপর তিনি তার নিজ নগর রামাতে ফিরে আসতেন। (১ শমূয়েল ৭:১৫-১৭) স্পষ্টতই, শমূয়েল সবসময় নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন এবং সেই ২০ বছরের সময়কালে তার অনেক কিছু করার ছিল।
এলির সন্তানদের অনৈতিকতা এবং কলুষতা লোকেদের বিশ্বাসকে নষ্ট করে দিয়েছিল। এর ফলে, অনেকে প্রতিমা পূজা করতে শুরু করেছিল বলে মনে হয়। কিন্তু দুই দশক ধরে কঠিন পরিশ্রম করার পর শমূয়েল লোকেদের কাছে এই বার্তা প্রদান করেছিলেন: “তোমরা যদি সর্ব্বান্তঃকরণে সদাপ্রভুর কাছে ফিরিয়া আইস, তবে আপনাদের মধ্য হইতে বিজাতীয় দেবগণকে ও অষ্টারোৎ দেবীগণকে দূর কর, ও সদাপ্রভুর দিকে আপন আপন অন্তঃকরণ সুস্থির কর, কেবল তাঁহারই সেবা কর; তাহা হইলে তিনি পলেষ্টীয়দের হস্ত হইতে তোমাদিগকে উদ্ধার করিবেন।”—১ শমূয়েল ৭:৩.
লোকেদের ওপর “পলেষ্টীয়দের হস্ত” ভারী হয়েছিল। ইস্রায়েলীয় সৈন্যবাহিনীকে সাংঘাতিকভাবে পরাজিত করার পর, পলেষ্টীয়রা কোনোরকম শাস্তি না পাওয়ার জন্য নির্দ্বিধায় ঈশ্বরের লোকেদের অত্যাচার করেছিল। কিন্তু শমূয়েল লোকেদেরকে এই আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, তারা যদি যিহোবার প্রতি ফিরে আসে, একমাত্র তাহলেই তাদের পরিস্থিতিগুলো পরিবর্তিত হবে। তারা কি তা করতে ইচ্ছুক ছিল? শমূয়েলের জন্য এটা আনন্দের বিষয় ছিল যে, তারা তাদের প্রতিমাগুলোকে দূর করে “কেবল সদাপ্রভুর সেবা করিতে লাগিল।” শমূয়েল মিস্পাতে এক সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন, যেটা হল যিরূশালেমের উত্তরে পার্বত্য দেশের একটা নগর। প্রতিমাপূজার সঙ্গে জড়িত তাদের অনেক পাপের জন্য লোকেরা একত্রিত হয়েছিল, উপবাস করেছিল ও অনুতপ্ত হয়েছিল।—১ শমূয়েল ৭:৪-৬.
কিন্তু, পলেষ্টীয়রা এই বিরাট সমাবেশের বিষয়ে জানতে পেরে গিয়েছিল ও এটাকে এক সুযোগ হিসেবে দেখেছিল। তারা যিহোবার সেই উপাসকদের ধ্বংস করার জন্য মিস্পাতে তাদের সৈন্যবাহিনী পাঠিয়েছিল। ইস্রায়েলীয়রা আসন্ন বিপদ সম্বন্ধীয় সংবাদটি শুনেছিল। ভীত হয়ে তারা শমূয়েলকে তাদের জন্য প্রার্থনা করতে বলেছিল। তিনি তা করেছিলেন আর সেইসঙ্গে একটা বলিও উৎসর্গ করেছিলেন। সেই পবিত্র অনুষ্ঠানের সময়ে, পলেষ্টীয় সৈন্যবাহিনী মিস্পার বিরুদ্ধে এসেছিল। এরপর যিহোবা শমূয়েলের প্রার্থনার উত্তর দিয়েছিলেন। রূপকভাবে বললে, যিহোবা ক্রোধে গর্জন করেছিলেন। তিনি ‘পলেষ্টীয়দের উপরে মহাবজ্রনাদে গর্জ্জন করিয়াছিলেন।’—১ শমূয়েল ৭:৭-১০.
আমাদেরকে কি সেই পলেষ্টীয়দেরকে এমন ছোটো ছেলেমেয়েদের মতো কল্পনা করা উচিত, যারা বিদ্যুৎ চমকানোর আওয়াজ শুনে ভয়ে ছুটে গিয়ে তাদের মায়েদের পিছনে লুকায়? না, তারা অদম্য, কঠিন চিত্তের যোদ্ধা ছিল। তাই এই বজ্রধ্বনি, তারা জানত এমন যেকোনো বজ্রধ্বনির চেয়ে নিশ্চয়ই আলাদা ছিল। এটা কি এই ‘মহা গর্জ্জনের’ তীব্র আওয়াজ ছিল? এটা কি এক স্বচ্ছ নীল আকাশ থেকে এসেছিল অথবা এটা কি পাহাড়ের ঢালে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল, যেটা বিভ্রান্তি ঘটিয়েছিল? যাই হোক না কেন, এটা পলেষ্টীয়দেরকে একেবারে বিভ্রান্তিতে ফেলেছিল ও ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। বিভ্রান্তিতে পড়ে, সঙ্গেসঙ্গে তারা শিকারি থেকে শিকারে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। ইস্রায়েলের লোকেরা মিস্পা থেকে বের হয়ে তাদেরকে পরাজিত করেছিল এবং তাদেরকে যিরূশালেমের দক্ষিণ-পশ্চিম অবধি, মাইলের পর মাইল ধরে তাড়া করেছিল।—১ শমূয়েল ৭:১১.
সেই যুদ্ধ ঈশ্বরের লোকেদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক পরিবর্তন ছিল। বিচারক হিসেবে শমূয়েলের দিনের বাকি সময়কালে পলেষ্টীয়রা পিছু হটেছিল। একটার পর একটা নগর ঈশ্বরের লোকেদের অধীনে ফিরে এসেছিল।—১ শমূয়েল ৭:১৩, ১৪.
অনেক শতাব্দী পর, প্রেরিত পৌল সেই বিশ্বস্ত বিচারক ও ভাববাদীদের তালিকায় শমূয়েলকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, যারা ‘ধার্ম্মিকতার অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন।’ (ইব্রীয় ১১:৩২, ৩৩) শমূয়েল নিশ্চয়ই ঈশ্বরের চোখে যা উত্তম ও সঠিক তা সম্পন্ন করার জন্য সাহায্য করেছিলেন। তিনি সফল হয়েছিলেন কারণ তিনি ধৈর্য সহকারে যিহোবার অপেক্ষা করেছিলেন, হতাশাগুলো সত্ত্বেও বিশ্বস্তভাবে তার কাজ করে গিয়েছিলেন। এ ছাড়া, তিনি উপলব্ধিবোধের এক মনোভাবও দেখিয়েছিলেন। মিস্পায় জয়লাভ করার পর, যিহোবা যেভাবে তাঁর লোকেদের সাহায্য করেছিলেন, সেটাকে স্মরণ করার জন্য শমূয়েল এক স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করেছিলেন।—১ শমূয়েল ৭:১২.
আপনি কি নিজে ‘ধার্ম্মিকতার অনুষ্ঠান করিতে’ চান? যদি চান, তাহলে শমূয়েলের ধৈর্য এবং তার নম্রতা ও উপলব্ধিবোধ থেকে আপনার শেখা উচিত। আমাদের মধ্যে কার-ই বা এই গুণাবলির প্রয়োজন নেই? তিনি যখন অপেক্ষাকৃতভাবে অল্পবয়সি ছিলেন, তখন এই ধরনের গুণাবলি অর্জন ও প্রদর্শন করা শমূয়েলের পক্ষে উত্তম ছিল, কারণ জীবনের শেষ বছরগুলোতে তিনি প্রচণ্ড হতাশাগুলোর মুখোমুখি হয়েছিলেন।
‘আপনার পুত্ত্রেরা আপনার পথে চলেনি’
পরবর্তী সময়ে আমরা যখন শমূয়েলকে দেখি, তখন তিনি ‘বৃদ্ধ হইয়া গিয়াছিলেন।’ এই সময়ের মধ্যে শমূয়েলের যোয়েল ও অবিয় নামে দুটো প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে ছিল আর তিনি বিচার করার কাজে তাকে সাহায্য করার জন্য তাদেরকে আস্থা সহকারে দায়িত্বভার দিয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, তিনি আস্থা রেখে ভুল করেছিলেন। যদিও শমূয়েল সৎ ও ধার্মিক ছিলেন কিন্তু তার ছেলেরা ন্যায়বিচারকে বিকৃত করে ও ঘুষ নিয়ে তাদের পদকে স্বার্থপর উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছিল।—১ শমূয়েল ৮:১-৩.
একদিন, ইস্রায়েলের প্রাচীনরা অভিযোগ করার জন্য এই বয়স্ক ভাববাদীর কাছে এসেছিল। তারা বলেছিল, ‘আপনার পুত্ত্রেরা আপনার পথে চলেনি।’ (১ শমূয়েল ৮:৪, ৫) শমূয়েল কি সমস্যার বিষয়ে জানতেন? বিবরণ তা বলে না। কিন্তু এলির বিপরীতে, নিশ্চিতভাবেই শমূয়েল এমন একজন বাবা ছিলেন না, যাকে দোষ দেওয়া যায়। তার ছেলেদের মন্দতাকে সংশোধন করতে ব্যর্থ হওয়ার এবং তার ছেলেদেরকে ঈশ্বরের চেয়ে বেশি গৌরব দেওয়ার জন্য যিহোবা এলিকে তিরস্কার করেছিলেন ও শাস্তি দিয়েছিলেন। (১ শমূয়েল ২:২৭-২৯) যিহোবা শমূয়েলের মধ্যে কখনোই এই ধরনের ত্রুটি খুঁজে পাননি।
তার ছেলেদের মন্দ আচরণ সম্বন্ধে জানতে পারার পর শমূয়েল লজ্জা, উদ্বেগ অথবা হতাশার জন্য যে-যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন, সেই বিষয়ে বিবরণ কিছু জানায় না। দুঃখের বিষয় যে, অনেক বাবা-মায়েরই একইরকম অনুভূতি হয়েছে। আজকের এই অন্ধকারময় সময়ে, বাবা-মায়ের কর্তৃত্ব এবং শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা সর্বত্র দেখা যায়। (২ তীমথিয় ৩:১-৫) বাবা-মায়েরা যারা সেই ধরনের যন্ত্রণা ভোগ করছে তারা হয়তো শমূয়েলের উদাহরণ থেকে কিছুটা সান্ত্বনা ও নির্দেশনা খুঁজে পেতে পারে। তিনি তার ছেলেদের অবিশ্বস্ততার পথের দ্বারা নিজের জীবনধারাকে সামান্যতমও পরিবর্তিত হতে দেননি। মনে রাখবেন, এমনকী যদি পরামর্শ এবং শাসন ব্যর্থও হয়, তবুও বাবা-মায়ের উদাহরণ হয়তো তাদের সন্তানদের হৃদয়ে পৌঁছাতে পারে। আর বাবা-মায়েদের সবসময়ই তাদের নিজেদের পিতা, যিহোবা ঈশ্বরকে গর্বিত করার সুযোগ রয়েছে—যেমনটা শমূয়েল করেছিলেন।
‘আমাদের উপরে এক জন রাজা নিযুক্ত করুন’
শমূয়েলের ছেলেরা চিন্তাও করতে পারেনি যে, তাদের লোভ এবং স্বার্থপরতার পরিণাম কত দূর পর্যন্ত পৌঁছাবে। ইস্রায়েলের প্রাচীনরা শমূয়েলকে বলেছিল: “এখন অন্য সকল জাতির ন্যায় আমাদের বিচার করিতে আপনি আমাদের উপরে এক জন রাজা নিযুক্ত করুন।” সেই দাবি কি শমূয়েলের কাছে এক প্রত্যাখ্যান বলে মনে হয়েছিল? সর্বোপরি, তিনি দশকের পর দশক ধরে যিহোবার হয়ে সেই লোকেদের বিচার করছিলেন। এখন তারা শমূয়েলের মতো শুধুমাত্র কোনো ভাববাদী নয় বরং তাদের বিচারক হওয়ার জন্য একজন রাজা চেয়েছিল। আশেপাশের জাতিগুলোর রাজা ছিল আর তাই ইস্রায়েলীয়রাও একজন রাজা চেয়েছিল! শমূয়েল কেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন? আমরা পড়ি যে, “তাঁহাদের এই কথা” তার দৃষ্টিতে “মন্দ বোধ হইল।”—১ শমূয়েল ৮:৫, ৬.
শমূয়েল যখন প্রার্থনায় বিষয়টা যিহোবার কাছে নিয়ে এসেছিলেন, তখন যিহোবা কীভাবে সাড়া দিয়েছিলেন তা লক্ষ্য করুন: “এই লোকেরা তোমার কাছে যাহা যাহা বলিতেছে, সেই সমস্ত বিষয়ে তাহাদের বাক্যে কর্ণপাত কর; কেননা তাহারা তোমাকে অগ্রাহ্য করিল, এমন নয়, আমাকেই অগ্রাহ্য করিল, যেন আমি তাহাদের উপরে রাজত্ব না করি।” শমূয়েলের জন্য তা কতই না সান্ত্বনাদায়ক কিন্তু এটা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের প্রতি প্রচণ্ড অপমানজনক ছিল! একজন মানব রাজা থাকার কারণে ইস্রায়েলীয়দেরকে যে-উচ্চমূল্য দিতে হবে, সেই বিষয়ে তাদেরকে সাবধান করার জন্য যিহোবা তাঁর ভাববাদীকে বলেছিলেন। শমূয়েল যখন সেইমতো কাজ করেছিলেন, তখন তারা জোর দিয়ে বলেছিল: “না, আমাদের উপরে এক জন রাজা চাই।” শমূয়েল যিনি সবসময় তার ঈশ্বরের প্রতি বাধ্য ছিলেন, তিনি যিহোবা যাকে বেছে নিয়েছিলেন তার কাছে গিয়ে তাকে রাজা হিসেবে অভিষিক্ত করেছিলেন।—১ শমূয়েল ৮:৭-১৯.
কিন্তু, শমূয়েল কীভাবে বাধ্যতা দেখিয়েছিলেন? অসন্তুষ্ট হয়ে, নিছক কর্তব্যের খাতিরে? তিনি কি হতাশাকে তার হৃদয়কে বিষাক্ত করতে আর এইভাবে তিক্ততাকে শিকড় বিস্তার করতে দিয়েছিলেন? এই ধরনের এক পরিস্থিতিতে অনেক পুরুষ হয়তো এভাবেই প্রতিক্রিয়া দেখাবে কিন্তু শমূয়েল সেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাননি। তিনি শৌলকে অভিষিক্ত করেছিলেন ও স্বীকার করেছিলেন যে, সেই ব্যক্তি ছিলেন স্বয়ং যিহোবার দ্বারা মনোনীত। তিনি শৌলকে চুম্বন করেছিলেন যেটা ছিল নতুন রাজাকে স্বাগত জানানোর এবং তার বশীভূত হওয়ার এক চিহ্ন। আর তিনি লোকেদেরকে বলেছিলেন: “তোমরা কি ইহাঁকে দেখিতেছ? ইনি সদাপ্রভুর মনোনীত; সমস্ত লোকের মধ্যে ইহাঁর তুল্য কেহ নাই।”—১ শমূয়েল ১০:১, ২৪.
যিহোবা যে-ব্যক্তিকে মনোনীত করেছিলেন, শমূয়েল তার মধ্যে থাকা ভুলত্রুটি নয় বরং ভালো বিষয়গুলোরই ওপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছিলেন। তার নিজের ক্ষেত্রে, তিনি অস্থিরচিত্ত লোকেদের অনুমোদন পাওয়ার চেয়ে ঈশ্বরের প্রতি নীতিনিষ্ঠা সম্বন্ধীয় তার নিজস্ব নথির ওপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছিলেন। (১ শমূয়েল ১২:১-৪) এ ছাড়া, তিনি ঈশ্বরের লোকেরা যে-আধ্যাত্মিক বিপদগুলোর মুখোমুখি হয়েছিল, সেগুলো সম্বন্ধে তাদেরকে পরামর্শ দেওয়ার এবং যিহোবার প্রতি বিশ্বস্ত থাকার জন্য উৎসাহিত করার দ্বারা বিশ্বস্তভাবে তার নিজের কার্যভার চালিয়ে গিয়েছিলেন। তার পরামর্শ তাদের হৃদয়ে পৌঁছেছিল আর লোকেরা তাদের হয়ে প্রার্থনা করার জন্য শমূয়েলের কাছে বিনতি করেছিল। তিনি তাদেরকে এই সঠিক উত্তর দিয়েছিলেন: “আমিই যে তোমাদের জন্য প্রার্থনা করিতে বিরত হইয়া সদাপ্রভুর বিরুদ্ধে পাপ করিব, তাহা দূরে থাকুক; আমি তোমাদিগকে উত্তম ও সরল পথ শিক্ষা দিব।”—১ শমূয়েল ১২:২১-২৪.
অন্য কাউকে যখন এক নির্দিষ্ট পদ বা সুযোগ পাওয়ার জন্য মনোনীত করা হয়েছিল, তখন আপনি কি কখনো হতাশাবোধ করেছিলেন? শমূয়েলের উদাহরণ এই বিষয়ে এক জোরালো অনুস্মারক যে, আমরা কখনোই ঈর্ষা বা তিক্ততাকে আমাদের হৃদয়ে শিকড় বিস্তার করতে দেব না। ঈশ্বর তাঁর বিশ্বস্ত প্রত্যেক দাসকে উপকারজনক, পরিতৃপ্তিদায়ক প্রচুর কাজ দিয়েছেন।
“তুমি কত কাল শৌলের জন্য শোক করিবে?”
শৌলের মধ্যে ভালো কিছু দেখাটা শমূয়েলের জন্য সঠিক ছিল; ইনি একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। দীর্ঘকায় ও আকর্ষণীয় আর সেইসঙ্গে সাহসী এবং সুদক্ষ হওয়া সত্ত্বেও, তিনি প্রথমদিকে বিনয়ী ও নম্র ছিলেন। (১ শমূয়েল ১০:২২, ২৩, ২৭) এই ধরনের উপহারগুলো ছাড়াও, তার আরেকটা মূল্যবান উপহার ছিল আর সেটা ছিল স্বাধীন ইচ্ছা অর্থাৎ তার জীবনধারা বেছে নেওয়ার এবং নিজের মতো সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার ক্ষমতা। (দ্বিতীয় বিবরণ ৩০:১৯) তিনি কি সেই উপহারকে ভালোভাবে ব্যবহার করেছিলেন?
দুঃখের বিষয় যে, একজন ব্যক্তি যখন ক্ষমতা লাভ করেন, তখন সেটা তাকে বিনয়ী হওয়ার মনোভাব হারাতে পরিচালিত করতে পারে। অল্প সময়ের মধ্যেই, শৌল গর্বিত হতে শুরু করেছিলেন। তিনি যিহোবার সেই আদেশগুলোর অবাধ্য হওয়া বেছে নিয়েছিলেন, যেগুলো শমূয়েল তাকে প্রদান করেছিলেন। একবার, শৌল অধৈর্য হয়ে এমন একটা বলি উৎসর্গ করেছিলেন, যেটা উৎসর্গ করার অধিকার কেবল শমূয়েলেরই ছিল। শমূয়েল তাকে কঠোরভাবে সংশোধন করেছিলেন ও ভাববাণী করেছিলেন যে, সেই রাজপদ শৌলের বংশ থেকে চলে যাবে। সেই সংশোধন থেকে শেখার পরিবর্তে, শৌল অবাধ্যতার আরও খারাপ কাজগুলো করে গিয়েছিলেন।—১ শমূয়েল ১৩:৮, ৯, ১৩, ১৪.
যিহোবা শমূয়েলের মাধ্যমে শৌলকে অমালেকীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বলেছিলেন। যিহোবা যে-নির্দেশনাগুলো দিয়েছিলেন, সেগুলোর মধ্যে তাদের দুষ্ট রাজা অগাগকে হত্যা করার একটা আদেশ অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু, শৌল অগাগকে ছেড়ে দিয়েছিলেন আর সেইসঙ্গে যে-লুটদ্রব্যগুলো ধ্বংস করার ছিল, সেগুলোর সবচেয়ে উত্তম জিনিসগুলো রেখে দিয়েছিলেন। শমূয়েল যখন তাকে সংশোধন করতে এসেছিলেন, তখন শৌল দেখিয়েছিলেন যে, তিনি কতখানি পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছেন। বিনয়ের সঙ্গে সংশোধনকে মেনে নেওয়ার পরিবর্তে, তিনি যুক্তি করেছিলেন, অজুহাত দেখিয়েছিলেন, তার আচরণকে ন্যায্য বলে দেখাতে চেয়েছিলেন, বিষয়টাকে এড়িয়ে গিয়েছিলেন এবং লোকেদের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করেছিলেন। লুটদ্রব্যের কিছু যিহোবার কাছে উৎসর্গ করার উদ্দেশে রাখা হয়েছিল এই দাবি করে শৌল যখন সংশোধনকে তুচ্ছ ও প্রত্যাখ্যান করার চেষ্টা করেছিলেন, তখন শমূয়েল সুপরিচিত এই কথাগুলো বলেছিলেন: “দেখ, বলিদান অপেক্ষা আজ্ঞাপালন উত্তম।” শমূয়েল সাহসের সঙ্গে সেই ব্যক্তিকে তিরস্কার করে যিহোবার সিদ্ধান্তকে প্রকাশ করেছিলেন: রাজপদ শৌলের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে অন্যজনকে—আরও উত্তম একজন ব্যক্তিকে দেওয়া হবে।—১ শমূয়েল ১৫:১-৩৩.
শৌলের ভুলগুলোর কারণে শমূয়েল খুবই দুঃখ পেয়েছিলেন। বিষয়টা নিয়ে তিনি সারারাত যিহোবার কাছে কেঁদেছিলেন। এমনকী তিনি সেই ব্যক্তির জন্য শোকও করেছিলেন। শমূয়েল শৌলের মধ্যে অনেক সম্ভাবনা, অনেক উত্তম গুণ দেখেছিলেন কিন্তু এখন তার সেই আশাগুলো চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। যে-ব্যক্তিকে তিনি একসময়ে জানতেন তিনি পালটে গিয়েছিলেন—তার সর্বোত্তম গুণাবলিকে হারিয়েছিলেন ও যিহোবার বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন। শমূয়েল পুনরায় শৌলকে দেখতে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কিন্তু পরে, যিহোবা কোমলভাবে শমূয়েলকে এই ভর্ৎসনা করেছিলেন: “তুমি কত কাল শৌলের জন্য শোক করিবে? আমি ত তাহাকে অগ্রাহ্য করিয়া ইস্রায়েলের রাজ্যচ্যুত করিয়াছি। তুমি তোমার শৃঙ্গ তৈলে পূর্ণ কর, যাও, আমি তোমাকে বৈৎলেহমীয় যিশয়ের নিকটে প্রেরণ করি, কেননা তাহার পুত্ত্রগণের মধ্যে আমি আপনার জন্য এক রাজাকে দেখিয়া রাখিয়াছি।”—১ শমূয়েল ১৫:৩৪, ৩৫; ১৬:১.
যিহোবার উদ্দেশ্য সম্পাদন সেই অসিদ্ধ মানুষের ওপর নির্ভর করে না, যারা সবসময় অনুগত থাকে না। একজন যদি অবিশ্বস্ত হয়ে পড়ে, তাহলে যিহোবা তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ করার জন্য আরেকজনকে খুঁজে নেবেন। তাই বৃদ্ধ শমূয়েল শৌলকে নিয়ে তার শোক করা বন্ধ করেছিলেন। যিহোবার নির্দেশনায়, শমূয়েল বৈৎলেহমে যিশয়ের বাড়িতে গিয়েছিলেন, যেখানে রূপবান কয়েকটা ছেলের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। কিন্তু, একেবারে প্রথম থেকেই যিহোবা শমূয়েলকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন: “তুমি উহার মুখশ্রীর বা কায়িক দীর্ঘতার প্রতি দৃষ্টি করিও না; . . . কেননা মনুষ্য যাহা দেখে, তাহা কিছু নয়; যেহেতু মনুষ্য প্রত্যক্ষ বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি করে, কিন্তু সদাপ্রভু অন্তঃকরণের প্রতি দৃষ্টি করেন।” (১ শমূয়েল ১৬:৭) অবশেষে সবচেয়ে ছোটো ছেলে দায়ূদের সঙ্গে শমূয়েলের দেখা হয়েছিল আর তিনিই ছিলেন যিহোবার মনোনীত!
শমূয়েল তার জীবনের শেষের বছরগুলোতে, শৌলের স্থানে দায়ূদকে মনোনীত করার ব্যাপারে যিহোবার সিদ্ধান্তের ন্যায্যতাকে আগের চেয়ে আরও স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। শৌল ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েছিলেন এবং ফল স্বরূপ দায়ূদকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন এবং তিনি একজন ধর্মভ্রষ্ট ব্যক্তিও হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু, দায়ূদ সুন্দর গুণাবলি—সাহস, নীতিনিষ্ঠা, বিশ্বাস এবং আনুগত্য—দেখিয়েছিলেন। শমূয়েলের মারা যাওয়ার অল্প কিছুদিন আগে, তার বিশ্বাস আগের চেয়ে আরও দৃঢ় হয়েছিল। তিনি দেখেছিলেন যে, এমন কোনো হতাশা নেই যেটাকে যিহোবা সারিয়ে তুলতে, দূর করতে অথবা আশীর্বাদে পরিণত করতে পারেন না। পরিশেষে, শমূয়েল মারা গিয়েছিলেন ও এক অসাধারণ জীবনের নথি রেখে গিয়েছিলেন, যে-জীবন প্রায় এক শতাব্দী দীর্ঘ ছিল। এই বিশ্বস্ত ব্যক্তির মৃত্যুতে সমস্ত ইস্রায়েল শোক করেছিল আর এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আজকের দিনে, যিহোবার দাসদের এটা জিজ্ঞেস করা উচিত, ‘আমি কি শমূয়েলের বিশ্বাসকে অনুকরণ করব?’ (w১১-E ০১/০১)
[১৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
প্রচণ্ড দুঃখ ও হতাশার সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য শমূয়েল কীভাবে তার লোকেদেরকে সাহায্য করতে পেরেছিলেন?
[১৮ পৃষ্ঠার চিত্র]
মন্দ পথে চলে গিয়েছিল এমন ছেলেরা থাকার হতাশার সঙ্গে শমূয়েল কীভাবে মোকাবিলা করেছিলেন?