জগতে থাকা কিন্তু এর অংশ নয়
“কিন্তু তোমরা ত জগতের নহ, . . . জগৎ তোমাদিগকে দ্বেষ করে।”—যোহন ১৫:১৯.
১. জগতের সাথে খ্রীষ্টানদের কোন্ সম্পর্ক রয়েছে, তথাপি জগৎ তাদের কোন্ দৃষ্টিতে দেখে?
শিষ্যদের সাথে তাঁর শেষ রাতে যীশু তাদের বলেছিলেন: “তোমরা ত জগতের নহ।” কোন্ জগৎ সম্বন্ধে তিনি কথা বলছিলেন? পূর্ববর্তী এক উপলক্ষে তিনি কি বলেননি যে: “ঈশ্বর জগৎকে এমন প্রেম করিলেন যে, আপনার একজাত পুত্ত্রকে দান করিলেন, যেন, যে কেহ তাঁহাতে বিশ্বাস করে, সে বিনষ্ট না হয়, কিন্তু অনন্ত জীবন পায়।” (যোহন ৩:১৬) শিষ্যেরা স্পষ্টতই ওই জগতের এক অংশ ছিলেন কারণ অনন্ত জীবনের জন্য যীশুর উপর বিশ্বাস অনুশীলন করার ক্ষেত্রে তারাই ছিলেন সর্বপ্রথম। তাহলে কেন যীশু এখন বলছেন যে তাঁর শিষ্যেরা জগৎ থেকে পৃথক? আর কেন তিনি এও বলেছিলেন যে: “কিন্তু তোমরা ত জগতের নহ, . . . এই জন্য জগৎ তোমাদিগকে দ্বেষ করে”?—যোহন ১৫:১৯.
২, ৩. (ক) খ্রীষ্টানেরা কোন্ “জগতের” অংশ হবে না? (খ) বাইবেল সেই ‘জগৎ’ সম্বন্ধে কী বলে খ্রীষ্টানেরা যার কোন অংশ নয়?
২ উত্তরটি হল যে, বাইবেল ‘জগৎ’ (গ্রীক, কসমস) শব্দটি ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করে থাকে। পূর্ববর্তী প্রবন্ধে যেমন ব্যাখ্যা করা হয়েছে, কখনও কখনও বাইবেলে ‘জগৎ’ শব্দটি সাধারণ মানবজাতিকে উল্লেখ করে। এটিই হচ্ছে সেই জগৎ যাকে ঈশ্বর প্রেম করেছেন ও যার জন্য যীশু মৃত্যুবরণ করেছিলেন। কিন্তু, খ্রীষ্টতত্ত্ব সম্বন্ধে অক্সফোর্ড ইতিহাস (ইংরাজি) উল্লেখ করে: “খ্রীষ্টীয় প্রয়োগে ‘জগৎ’ পরিভাষাটি এমন কিছুর ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে যা ঈশ্বর থেকে বিচ্ছিন্ন ও তাঁর বিরুদ্ধে শত্রুতাপ্রবণ।” এটি কিভাবে সত্য? ক্যাথলিক গ্রন্থকার রোলান মিনেরাত লা ক্রেটয়ান এ লে মন্ড (খ্রীষ্টানেরা ও জগৎ) নামক তার বইয়ে ব্যাখ্যা করেন: “নেতিবাচক অর্থে গ্রহণ করলে জগৎ এমন একটি রাজ্য হিসাবে প্রতীত হয় . . . যেখানে ক্ষমতাগুলি ঈশ্বরের বিরুদ্ধে শত্রুতাপূর্ণভাবে তাদের কার্যকলাপ করে থাকে আর যেটি খ্রীষ্টের বিজয়ী শাসনের বিরোধিতা করার কারণে শয়তানের নিয়ন্ত্রণাধীনে এক শত্রু সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।” এই ‘জগৎ’ সেই মনুষ্য সমাজ যেটি ঈশ্বর থেকে বিচ্ছিন্ন। সত্য খ্রীষ্টানেরা এই জগতের কোন অংশ নয় আর এটি তাদের ঘৃণা করে।
৩ প্রথম শতাব্দীর শেষের দিকে যোহনের মনে এই জগৎটি ছিল যখন তিনি লিখেছিলেন: “তোমরা জগৎকে প্রেম করিও না, জগতীস্থ বিষয় সকলও প্রেম করিও না। কেহ যদি জগৎকে প্রেম করে, তবে পিতার প্রেম তাহার অন্তরে নাই। কেননা জগতে যে কিছু আছে, মাংসের অভিলাষ, চক্ষুর অভিলাষ, ও জীবিকার দর্প, এ সকল পিতা হইতে নয়, কিন্তু জগৎ হইতে হইয়াছে।” (১ যোহন ২:১৫, ১৬) তিনি আরও লিখেছিলেন: “আমরা জানি যে, আমরা ঈশ্বর হইতে; আর সমস্ত জগৎ সেই পাপাত্মার মধ্যে শুইয়া রহিয়াছে।” (১ যোহন ৫:১৯) যীশু নিজে শয়তানকে “এ জগতের অধিপতি” বলে সম্বোধন করেছিলেন।—যোহন ১২:৩১; ১৬:১১.
বিশ্বশক্তিগুলির বৃদ্ধি
৪. কিভাবে বিশ্বশক্তিগুলি অস্তিত্বে এসেছিল?
৪ বর্তমানে অস্তিত্বশীল মনুষ্যজাতির জগৎ যেটি ঈশ্বর থেকে বিচ্ছিন্ন, নোহের দিনের জল প্লাবনের অল্প কিছু পরেই বিকাশলাভ করতে শুরু করেছিল যখন নোহের বংশধরদের অনেকে যিহোবা ঈশ্বরের উপাসনা করা বন্ধ করে দিয়েছিল। সেই প্রারম্ভিক দিনগুলিতে নিম্রোদ ছিলেন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি যিনি এক নগর নির্মাণকারী এবং “সদাপ্রভুর সাক্ষাতে পরাক্রান্ত ব্যাধ হইলেন।” (আদিপুস্তক ১০:৮-১২) সেই সময়ে এই জগতের অধিকাংশই ছোট ছোট নগর-রাজ্যগুলিতে সংগঠিত ছিল যেগুলি সময়ে সময়ে অস্থায়ী সন্ধি স্থাপন করত ও একে অপরের সাথে যুদ্ধে রত থাকত। (আদিপুস্তক ১৪:১-৯) কিছু নগর-রাজ্যগুলি অন্যদের উপর আধিপত্য লাভ করে প্রাদেশিক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। কালক্রমে কিছু প্রাদেশিক শক্তিগুলি বৃদ্ধি পেয়ে বৃহৎ বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়েছিল।
৫, ৬. (ক) বাইবেল ইতিহাসে সাতটি বিশ্বশক্তি কী কী? (খ) কিভাবে এই বিশ্বশক্তিগুলিকে চিত্রিত করা হয়েছে এবং কোথা থেকে তাদের শক্তি আসে?
৫ নিম্রোদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বিশ্বশক্তিগুলির শাসকেরা যিহোবার উপাসনা করেনি, যে সত্যটি তাদের নিষ্ঠুর, দৌরাত্ম্যপূর্ণ কাজের দ্বারা প্রতিফলিত হয়েছিল। শাস্ত্রে এই বিশ্বশক্তিগুলিকে বন্য পশু দ্বারা চিত্রিত করা হয়েছে আর শতাব্দীগুলি ধরে বাইবেল এদের ছয়টিকে শনাক্ত করে, যিহোবার লোকেদের উপর যেগুলির শক্তিশালী প্রভাব ছিল। এগুলি ছিল মিশর, অশূর, বাবিলন, মাদীয়-পারশ্য গ্রীস ও রোম। রোমের পর এক সপ্তম বিশ্বশক্তির উত্থান সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল। (দানিয়েল ৭:৩-৭; ৮:৩-৭, ২০, ২১; প্রকাশিত বাক্য ১৭:৯, ১০) এটি অ্যাংলো আমেরিকান বিশ্বশক্তি হিসাবে প্রমাণিত হয়েছিল যেটি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মৈত্রীবন্ধনের দ্বারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল যা কালক্রমে ক্ষমতার দ্বারা ব্রিটেনকে গ্রাস করেছিল। রোমীয় সাম্রাজ্যের শেষ সাক্ষ্য চূড়ান্তভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিকশিত হতে শুরু করেছিল।a
৬ ধারাবাহিক সাতটি বিশ্বশক্তিকে প্রকাশিত বাক্য পুস্তকে সপ্ত মস্তক বিশিষ্ট এক বন্যপশুর সাতটি মস্তক দ্বারা চিত্রিত করা হয়েছে যেটি অশান্ত মনুষ্য সমুদ্র থেকে উত্থিত হয়। (যিশাইয় ১৭:১২, ১৩; ৫৭:২০, ২১; প্রকাশিত বাক্য ১৩:১) এই শাসনরত পশুকে কে তার ক্ষমতা প্রদান করেছে? বাইবেল উত্তর দেয়: “সেই নাগ আপনার পরাক্রম ও আপনার সিংহাসন ও মহৎ কর্ত্তৃত্ব তাহাকে দান করিল।” (প্রকাশিত বাক্য ১৩:২) এই নাগ শয়তান দিয়াবল ছাড়া আর কেউ নয়।—লূক ৪:৫, ৬; প্রকাশিত বাক্য ১২:৯.
ঈশ্বরের রাজ্যের আগত শাসন
৭. খ্রীষ্টানদের আশা কী আর জগতের সরকারগুলির সাথে তাদের সম্পর্ককে এটি কিভাবে প্রভাবিত করে?
৭ প্রায় ২০০০ বছর ধরে খ্রীষ্টানেরা প্রার্থনা করেছে: “তোমার রাজ্য আইসুক, তোমার ইচ্ছা সিদ্ধ হউক, যেমন স্বর্গে তেমনি পৃথিবীতেও হউক।” (মথি ৬:১০) যিহোবার সাক্ষীরা জানে যে কেবলমাত্র ঈশ্বরের রাজ্যই পৃথিবীতে প্রকৃত শান্তি নিয়ে আসতে পারে। বাইবেল ভবিষ্যদ্বাণীর ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষক হওয়ায় তারা প্রত্যয়ী যে শীঘ্রই এই প্রার্থনার উত্তর দেওয়া হবে আর ক্ষণকাল পরেই রাজ্য পৃথিবীস্থ বিষয়গুলির তত্ত্বাবধান করবে। (দানিয়েল ২:৪৪) এই রাজ্যের প্রতি তাদের আনুগত্য, জগতের সরকারগুলির বিষয়ে তাদের নিরপেক্ষ করে তোলে।
৮. যেমন গীতসংহিতা ২ অধ্যায়ে ভাববাণী করা হয়েছিল, ঈশ্বরের রাজ্যের শাসনের প্রতি সরকারগুলি কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়?
৮ কিছু জাতি ধর্মীয় নীতিগুলি পালন করে বলে দাবি করে থাকে। তবুও, কার্যত তারা এই সত্যটিকে অবজ্ঞা করে যে যিহোবা হচ্ছেন সার্বজনীন সার্বভৌম আর তিনি পৃথিবীর উপর কর্তৃত্বভার প্রদান করে স্বর্গীয় রাজা হিসাবে যীশু খ্রীষ্টকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। (দানিয়েল ৪:১৭; প্রকাশিত বাক্য ১১:১৫) একটি ভবিষ্যদ্বাণীমূলক গীত উল্লেখ করে: “পৃথিবীর রাজগণ দণ্ডায়মান হয়, নায়কগণ একসঙ্গে মন্ত্রণা করে, সদাপ্রভুর বিরুদ্ধে এবং তাঁহার অভিষিক্ত ব্যক্তির [যীশুর] বিরুদ্ধে; [বলে,] ‘আইস, আমরা উহাদের বন্ধন ছিড়িয়া ফেলি, আপনাদের হইতে উহাদের রজ্জু খুলিয়া ফেলি।’” (গীতসংহিতা ২:২, ৩) সরকারগুলি কোনরকম ঐশিক “বন্ধন” অথবা “রজ্জু” গ্রহণ করে না যা তাদের জাতিগত সার্বভৌমত্বের অনুশীলনকে সীমাবদ্ধ করবে। অতএব, যিহোবা তাঁর মনোনীত রাজা যীশুকে বলেন: “আমার নিকটে যাচ্ঞা কর, আমি জাতিগণকে তোমার দায়াংশ করিব, পৃথিবীর প্রান্ত সকল তোমার অধিকারে আনিয়া দিব। তুমি লৌহদণ্ড দ্বারা তাহাদিগকে ভাঙ্গিবে, কুম্ভকারের পাত্রের ন্যায় খণ্ড বিখণ্ড করিবে।” (গীতসংহিতা ২:৮, ৯) কিন্তু, মনুষ্যজাতির সেই জগৎ যার জন্য যীশু মৃত্যুবরণ করেছিলেন তা সম্পূর্ণভাবে “ভাঙ্গিবে” না।—যোহন ৩:১৭.
“পশুর” “ছাব” এড়িয়ে চলা
৯, ১০. (ক) প্রকাশিত বাক্য পুস্তকে আমাদের কোন্ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে? (খ) ‘পশুর ছাব’ ধারণ করা কোন্ বিষয়টিকে চিত্রিত করে? (গ) কোন্ ছাপটি ঈশ্বরের দাসেরা গ্রহণ করে?
৯ প্রেরিত যোহনের দ্বারা গৃহীত প্রকাশিত বাক্য সতর্ক করেছিল যে ঈশ্বর থেকে বিচ্ছিন্ন মনুষ্যজাতির জগৎ, এটি শেষ হয়ে যাওয়ার পূর্বমুহূর্তে বর্ধিতভাবে কিছু দাবি করবে যেটি হল তা “ক্ষুদ্র ও মহান্, ধনী ও দরিদ্র, স্বাধীন ও দাস, সকলকেই দক্ষিণ হস্তে কিম্বা ললাটে ছাব ধারণ করায়; আর ঐ . . . ছাব . . . যে কেহ ধারণ না করে, তাহার ক্রয় বিক্রয় করিবার অধিকার বদ্ধ করে।” (প্রকাশিত বাক্য ১৩:১৬, ১৭) এটির অর্থ কী? দক্ষিণ হস্তে একটি ছাপ সক্রিয় সমর্থনের এক যর্থার্থ প্রতীক। ললাটের ছাপ সম্বন্ধে কী বলা যায়? দি এক্সপোজিটারস গ্রীক টেস্টামেন্ট উল্লেখ করে: “এই উচ্চ প্রতীকাত্মক পরোক্ষ উল্লেখ সৈন্য ও দাসেদের এক বিশিষ্ট সংকেত বা নির্দেশক চিহ্ন দ্বারা চিহ্নিত করার অভ্যাস . . . ; অথবা আরও প্রভাবশালী, ঈশ্বরের নামকে মন্ত্রপূত রক্ষাকবচ হিসাবে পরিধান করার ধর্মীয় প্রথাকে ইঙ্গিত করে।” অনেক লোকেরা তাদের নিজেদেরকে সেই ‘পশুর’ “দাস” অথবা “সৈন্য” হিসাবে পরিচিত করিয়ে তাদের কাজ ও কথার দ্বারা প্রতীকাত্মকভাবে এই ছাপ পরিধান করে। (প্রকাশিত বাক্য ১৩:৩, ৪) তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নতুন নিয়ম সম্বন্ধে ঈশ্বরতত্ত্বের অভিধান (ইংরাজি) বলে: “ঈশ্বরের শত্রুরা পশুর এই [ছাপ] অর্থাৎ সেই রহস্যজনক সংখ্যা যেটি তার নামকে অন্তর্ভুক্ত করে তাদের ললাটে ও এক হস্তে মুদ্রিত করতে অনুমোদন করে। এটি তাদের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে বিরাট সুযোগ সুবিধাগুলি প্রদান করে কিন্তু এটি তাদের ঈশ্বরের ক্রোধের অধীনে নিয়ে আসে ও সহস্র বছরের রাজ্য থেকে তাদের বহিষ্কৃত করে, প্রকা. ১৩:১৬; ১৪:৯; ২০:৪.”
১০ এই “ছাব” গ্রহণ করার চাপকে প্রতিরোধ করার জন্য অনেক অনেক সাহস ও ধৈর্যের প্রয়োজন। (প্রকাশিত বাক্য ১৪:৯-১২) যাইহোক, ঈশ্বরের দাসেদের এই শক্তি রয়েছে আর সেই কারণে তারা প্রায়ই ঘৃণিত ও নিগৃহীত হয়ে থাকে। (যোহন ১৫:১৮-২০; ১৭:১৪, ১৫) সেই পশুর ছাপকে বহন করার চেয়ে বরঞ্চ যেমন যিশাইয় বলেছিলেন তারা তাদের হস্তে প্রতীকাত্মকভাবে “সদাপ্রভুর উদ্দেশে” এটি লিপিবদ্ধ করে। (যিশাইয় ৪৪:৫) এছাড়াও, যেহেতু তারা ধর্মভ্রষ্ট ধর্মগুলির কৃত সমস্ত ঘৃণার্হ কার্যের জন্য “দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করে ও কোঁকায়,” তাই তারা তাদের কপালে এক প্রতীকাত্মক ছাপ গ্রহণ করে যেটি তাদের যিহোবার সম্পাদিত বিচার থেকে অব্যাহতি পাওয়ার যোগ্য হিসাবে শনাক্ত করবে।—যিহিষ্কেল ৯:১-৭.
১১. পৃথিবীর উপর ঈশ্বরের রাজ্য কর্তৃত্বভার গ্রহণ করার পূর্ব পর্যন্ত কে মনুষ্য সরকারগুলিকে শাসন করতে অনুমোদন করেন?
১১ ঈশ্বর মনুষ্য সরকারগুলিকে ততদিন পর্যন্ত শাসন করতে অনুমোদন করেন যতদিন পর্যন্ত না খ্রীষ্টের স্বর্গীয় সরকারের সম্পূর্ণভাবে এই পৃথিবীর শাসনভার গ্রহণ করার সময় হয়। নতুন নিয়মে রাষ্ট্র (ইংরাজি) নামক তার বইয়ে অধ্যাপক অস্কার কুলম্যান, রাজনৈতিক রাষ্ট্রগুলির প্রতি এই ঐশিক অনুমোদন সম্বন্ধে উল্লেখ করেছেন। তিনি লেখেন: “রাষ্ট্রগুলির অস্থায়ী প্রকৃতির জটিল ধারণাই হচ্ছে সেই কারণ যে কেন রাষ্ট্রের প্রতি প্রাথমিক খ্রীষ্টানদের মনোভাব ঐক্যমূলক নয় বরঞ্চ বিরোধীমূলক বলে প্রতীয়মান হয়। আমি জোরের সাথে বলব যে এটি সেইরকমই প্রতীয়মান হয়। আমাদের কেবলমাত্র রোমীয় ১৩:১ পদটি ‘প্রত্যেক প্রাণী মনুষ্য শক্তিগুলির বশীভূত হউক . . . ,’ প্রকাশিত বাক্য ১৩ অধ্যায়ের পাশাপাশি উল্লেখ করা প্রয়োজন যেখানে এটি বলে রাষ্ট্র অগাধলোকের পশু।”
“পশু” এবং “কৈসর”
১২. মনুষ্য সরকারগুলি সম্পর্কে যিহোবার সাক্ষীদের কোন্ ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি আছে?
১২ সরকারসুলভ কর্তৃপক্ষের সমস্ত মানুষই শয়তানের প্রতিনিধি এইভাবে উপসংহার করা অনুচিত হবে। অনেকেই নিজেদের নীতিবান লোক হিসাবে প্রমাণ করেছেন যেমন দেশাধ্যক্ষ সের্গিয় পৌল যিনি বাইবেলে “এক জন বুদ্ধিমান্ লোক” বলে বর্ণিত হয়েছেন। (প্রেরিত ১৩:৭) কিছু শাসকেরা তাদের ঈশ্বর-দত্ত বিবেক দ্বারা পরিচালিত হয়ে সাহসের সাথে সংখ্যালঘুদের অধিকারকে রক্ষা করেছে, এমনকি যদিও তারা যিহোবা ও তাঁর উদ্দেশ্যগুলি সম্বন্ধে জানত না। (রোমীয় ২:১৪, ১৫) স্মরণ করুন যে, বাইবেল দুটি বৈসাদৃশ্যমূলক উপায়ে ‘জগৎ’ শব্দটি ব্যবহার করে: মনুষ্যজাতির জগৎ যেটিকে ঈশ্বর প্রেম করেন ও আমাদেরও প্রেম করা উচিত আর ঈশ্বর থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষের জগৎ যেটির দেব শয়তান আর যেটি থেকে আমাদের অবশ্যই পৃথক থাকতে হবে। (যোহন ১:৯, ১০; ১৭:১৪; ২ করিন্থীয় ৪:৪; যাকোব ৪:৪) তাই, মনুষ্য শাসনের প্রতি যিহোবার দাসেদের এক ভারসাম্যপূর্ণ মনোভাব রয়েছে। আমরা রাজনৈতিক বিষয়ে নিরপেক্ষ যেহেতু আমরা ঈশ্বরের রাজ্যের রাজদূত বা প্রেরিত দূত হিসাবে সেবা করি ও আমাদের জীবন ঈশ্বরের প্রতি উৎসর্গীকৃত। (২ করিন্থীয় ৫:২০) অপরপক্ষে, আমরা কর্তৃপক্ষের প্রতি বিবেকবুদ্ধিপূর্ণভাবে বশীভূত।
১৩. (ক) যিহোবা মনুষ্য সরকারগুলিকে কোন্ দৃষ্টিতে দেখেন? (খ) মনুষ্য সরকারগুলির প্রতি খ্রীষ্টীয় বশ্যতা কতদূর পর্যন্ত প্রসারিত?
১৩ এই ভারসাম্যপূর্ণ মনোভাব যিহোবা ঈশ্বরের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত করে। যখন বিশ্বশক্তিগুলি অথবা এমনকি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র তাদের কর্তৃত্বের অপব্যবহার করে, তাদের লোকেদের পীড়ন করে অথবা যারা ঈশ্বরের উপাসনা করে তাদের উপর তাড়না নিয়ে আসে, তখন নিশ্চিতভাবেই তারা হিংস্র পশু হিসাবে তাদের সম্বন্ধে ভাববাণীমূলক বিবরণের যোগ্য প্রতিপন্ন হয়। (দানিয়েল ৭:১৯-২১; প্রকাশিত বাক্য ১১:৭) কিন্তু, যখন জাতীয় সরকারগুলি ন্যায্যভাবে আইন ও শৃঙ্খলা বজায় রেখে ঈশ্বরের উদ্দেশ্য পূর্ণ করে তিনি তাদের “সেবাকারী” হিসাবে বিবেচনা করেন। (রোমীয় ১৩:৬) যিহোবা তাঁর লোকেদের কাছে প্রত্যাশা করেন যে তারা মনুষ্য সরকারগুলিকে সম্মান করবে ও তাদের বশ্যতা স্বীকার করবে কিন্তু তাদের বশ্যতা সীমাহীন হবে না। যখন ঈশ্বরের দাসেদের থেকে মানুষেরা এমন কিছু দাবি করে থাকে যা ঈশ্বরের আইন নিষিদ্ধ করে অথবা যখন তারা সেটিকে নিষিদ্ধ করে যেটি করুক বলে ঈশ্বর তাঁর দাসেদের কাছ থেকে চান তখন তারা প্রেরিতদের দ্বারা অবলম্বিত বিষয়টি অনুসরণ করে অর্থাৎ: “মনুষ্যদের অপেক্ষা বরং ঈশ্বরের আজ্ঞা পালন করিতে হইবে।”—প্রেরিত ৫:২৯.
১৪. কিভাবে মনুষ্য সরকারগুলির প্রতি খ্রীষ্টীয় বশ্যতাকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যীশুর দ্বারা? পৌলের দ্বারা?
১৪ যীশু বলেছিলেন যে তাঁর অনুগামীদের সরকার ও ঈশ্বর উভয়ের প্রতি কর্তব্য থাকবে যখন তিনি ঘোষণা করেছিলেন: “তবে কৈসরের যাহা যাহা, কৈসরকে দেও, আর ঈশ্বরের যাহা যাহা, ঈশ্বরকে দেও।” (মথি ২২:২১) অনুপ্রেরণার অধীনে প্রেরিত পৌল লিখেছিলেন: “প্রত্যেক প্রাণী প্রাধান্যপ্রাপ্ত কর্ত্তৃপক্ষদের বশীভূত হউক; . . . কিন্তু যদি মন্দ আচরণ কর, তবে ভীত হও, কেননা তিনি বৃথা খড়্গ ধারণ করেন না; কারণ তিনি ঈশ্বরের পরিচারক, যে মন্দ আচরণ করে, ক্রোধ সাধনের জন্য তাহার প্রতিশোধদাতা। অতএব কেবল ক্রোধের ভয়ে নয়, কিন্তু সংবেদেরও নিমিত্ত বশীভূত হওয়া আবশ্যক। কারণ এই জন্য তোমরা রাজকরও দিয়া থাক।” (রোমীয় ১৩:১, ৪-৬) সা.কা. প্রথম শতাব্দী থেকে আজ পর্যন্ত, রাষ্ট্র দ্বারা কৃত দাবিগুলির প্রতি খ্রীষ্টানেরা বিবেচনা দেখিয়েছে। তাদের উপলব্ধি করার প্রয়োজন হয়েছে যে এই দাবিগুলিকে মেনে চলা তাদের উপাসনাকে আপোশ করায় পরিচালিত করবে অথবা এইধরনের দাবিগুলি বৈধ এবং বিবেকবুদ্ধিপূর্ণভাবে সেগুলিকে মেনে চলা উচিত।
বিবেকবুদ্ধিপূর্ণ নাগরিকেরা
১৫. কিভাবে যিহোবার সাক্ষীরা বিবেকবুদ্ধিপূর্ণভাবে কৈসরের যা প্রাপ্য তা প্রদান করে?
১৫ রাজনৈতিক “প্রধান্যপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ” ঈশ্বরের “পরিচারক” হয়ে ওঠে যখন তারা তাদের ঈশ্বর অনুমোদিত ভূমিকা পালন করে যার অন্তর্ভুক্ত ‘দুরাচারদের প্রতিফল দেওয়া ও সদাচারদের প্রশংসা করা।’ (১ পিতর ২:১৩, ১৪) যিহোবার দাসেরা বিবেকবুদ্ধিপূর্ণভাবে কৈসরের প্রাপ্য তাকে প্রদান করে যা তিনি বৈধভাবে করের মাধ্যমে দাবি করে থাকেন আর ‘তাহারা আধিপত্যের ও কর্ত্তৃত্বের . . . বাধ্য হওয়া, সর্ব্বপ্রকার সৎক্রিয়ার জন্য প্রস্তুত হওয়ার’ ক্ষেত্রে তাদের বাইবেল ভিত্তিক বিবেক যতদূর পর্যন্ত যেতে অনুমোদন করে তারা তা করে থাকে। (তীত ৩:১) ‘সৎক্রিয়া’ অন্যদের সাহায্য করাকেও অন্তর্ভুক্ত করে যেমন যখন দুর্যোগ আঘাত করে। অনেকেই এই পরিস্থিতিগুলিতে সহমানবদের প্রতি প্রর্দশিত যিহোবার সাক্ষীদের দয়া সম্বন্ধে সাক্ষ্য দিয়ে থাকেন।—গালাতীয় ৬:১০.
১৬. সরকারগুলি ও সহমানবদের প্রতি কোন্ সৎক্রিয়া যিহোবার সাক্ষীরা বিবেকবুদ্ধিপূর্ণভাবে সম্পাদন করে থাকে?
১৬ যিহোবার সাক্ষীরা তাদের সহমানবদের ভালবাসে আর এটি অনুভব করে যে সর্বোত্তম সৎক্রিয়া যেটি তারা তাদের জন্য করতে পারে সেটি হল ধার্মিক ‘নূতন আকাশমণ্ডল ও নূতন পৃথিবী’ নিয়ে আসা সম্বন্ধীয় ঈশ্বরের উদ্দশ্যের বিষয়ে তাদের এক যর্থার্থ জ্ঞানে পৌঁছাতে সাহায্য করা। (২ পিতর ৩:১৩) বাইবেলের উচ্চ নৈতিক মান সম্বন্ধে শিক্ষা দেওয়া ও তা অভ্যাস করায় তারা মনুষ্য সমাজের জন্য এক সম্পদস্বরূপ, যারা অনেককে অপরাধমূলক কাজ থেকে রক্ষা করে। যিহোবার দাসেরা নিয়ম মান্যকারী এবং “যাঁহাকে সমাদর করিতে হয়,” তাদের সমাদর করে তারা সরকারি পরিচারক, আধিকারিক, বিচারক এবং নগরাধিপতিদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে। (রোমীয় ১৩:৭) সাক্ষী পিতামাতারা তাদের সন্তানদের বিদ্যালয় শিক্ষকদের সাথে আনন্দের সাথে সহযোগিতা করেন এবং তাদের সন্তানদের ভালভাবে অধ্যয়ন করতে সাহায্য করেন যেন পরবর্তী সময়ে তারা জীবনধারণের জন্য উপার্জনে সমর্থ হয় ও সমাজের বোঝাস্বরূপ না হয়। (১ থিষলনীকীয় ৪:১১, ১২) তাদের মণ্ডলীর মধ্যে সাক্ষীরা জাতিগত কুসংস্কার ও শ্রেণী বৈষম্যকে প্রতিরোধ করে আর তারা পারিবারিক জীবনকে শক্তিশালী করার জন্য অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। (প্রেরিত ১০:৩৪, ৩৫; কলসীয় ৩:১৮-২১) সুতরাং, তাদের কাজের দ্বারা তারা দেখায় যে, পরিবার বিরোধী ও সমাজের প্রতি অসহযোগী হওয়া সম্বন্ধে তাদের প্রতি নিয়ে আসা অভিযোগ মিথ্যা। এইভাবে প্রেরিত পিতরের বাক্যগুলি সত্য প্রমাণিত হয়: “ঈশ্বরের ইচ্ছা এই, যেন এইরূপে তোমরা সদাচরণ করিতে করিতে নির্ব্বোধ মনুষ্যদের অজ্ঞানতাকে নিরুত্তর কর।”—১ পিতর ২:১৫.
১৭. কিভাবে খ্রীষ্টানেরা “বাহিরের লোকদের প্রতি বুদ্ধিপূর্ব্বক আচরণ” করে চলতে পারে?
১৭ তাই যদিও খ্রীষ্টের অকৃত্রিম অনুগামীরা “জগতের নয়,” তবু তারা মনুষ্য সমাজের জগতের অংশ আর তাই অবশ্যই “বাহিরের লোকদের প্রতি বুদ্ধিপূর্ব্বক আচরণ” করবে। (যোহন ১৭:১৬; কলসীয় ৪:৫) যতদিন পর্যন্ত যিহোবা প্রধান্যপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষদের তাঁর পরিচারক হিসাবে কাজ করতে অনুমতি দেন, আমরা তাদের প্রতি উপযুক্ত শ্রদ্ধা প্রদর্শন করব। (রোমীয় ১৩:১-৪) রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ থেকেও আমরা “রাজাদের ও উচ্চপদস্থ সকলের নিমিত্ত” প্রার্থনা করে থাকি, বিশেষ করে যখন তারা সেই সিদ্ধান্তগুলি নিয়ে থাকেন যা উপাসনার স্বাধীনতাকে প্রভাবিত করতে পারে। আমরা ক্রমাগত এটি করে চলব “যেন আমরা সম্পূর্ণ ভক্তিতে ও ধীরতায় নিরুদ্বেগ ও প্রশান্ত জীবন যাপন করিতে পারি” যেন “সমুদয় মনুষ্য পরিত্রাণ পায়।”—১ তীমথিয় ২:১-৪.
[পাদটীকাগুলো]
a ওয়াচটাওয়ার বাইবেল অ্যান্ড ট্র্যাক্ট সোসাইটি দ্বারা প্রকাশিত প্রকাশিত বাক্য—এর মহান পরিপূর্ণতা সন্নিকট! (ইংরাজি) নামক বইয়ের ৩৫ অধ্যায়টি দেখুন।
পুনরালোচনার জন্য প্রশ্নাবলী
◻ খ্রীষ্টানেরা কোন্ “জগতের” অংশ কিন্তু কোন্ “জগতের” অংশ তারা হতে পারে না?
◻ এক ব্যক্তির হস্তে ও ললাটে “পশুর” “ছাব” দ্বারা কী চিত্রিত করা হয়েছে আর যিহোবার বিশ্বস্ত দাসেদের কোন্ ছাপ রয়েছে?
◻ মনুষ্য সরকারগুলির প্রতি সত্য খ্রীষ্টানদের কোন্ ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে?
◻ কিছু উপায়গুলি কী যে ক্ষেত্রে মানব সমাজের মঙ্গলের জন্য যিহোবার সাক্ষীরা অবদান রাখে?
[১৬ পৃষ্ঠার চিত্র]
বাইবেল মনুষ্য সরকারগুলিকে ঈশ্বরের সেবক ও বন্য পশু উভয় রূপে শনাক্ত করে
[১৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
অন্যদের প্রতি প্রেমপূর্ণ উদ্বেগ প্রদর্শন করার কারণে যিহোবার সাক্ষীরা তাদের সমাজের জন্য সম্পদস্বরূপ