খ্রীষ্টানেরা এবং মনুষ্যজাতির জগৎ
“তোমরা বাহিরের লোকদের প্রতি বুদ্ধিপূর্ব্বক আচরণ কর।”—কলসীয় ৪:৫.
১. তাঁর অনুগামীদের ও জগৎ সম্বন্ধে যীশু কী বলেছিলেন?
তাঁর স্বর্গীয় পিতার কাছে এক প্রার্থনায় যীশু তাঁর অনুগামীদের সম্পর্কে বলেছিলেন: “জগৎ তাহাদিগকে দ্বেষ করিয়াছে, কারণ তাহারা জগতের নয় যেমন আমিও জগতের নই।” তারপর তিনি আরও বলেছিলেন: “আমি নিবেদন করিতেছি না যে, তুমি তাহাদিগকে জগৎ হইতে লইয়া যাও, কিন্তু তাহাদিগকে সেই পাপাত্মা হইতে রক্ষা কর।” (যোহন ১৭:১৪, ১৫) দৈহিকভাবে খ্রীষ্টানদের জগৎ থেকে পৃথক হওয়ার ছিল না—উদাহরণস্বরূপ, মঠে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করার দ্বারা। বরঞ্চ, খ্রীষ্ট “পৃথিবীর প্রান্ত পর্য্যন্ত” তাঁর সাক্ষী হওয়ার জন্য ‘তাহাদিগকে জগতে প্রেরণ করিয়াছিলেন।’ (প্রেরিত ১:৮; যোহন ১৭:১৮) তবুও, তাদের রক্ষা করার জন্য তিনি ঈশ্বরের কাছে অনুরোধ করেছিলেন কারণ “এ জগতের অধিপতি” শয়তান, খ্রীষ্টের নাম প্রযুক্ত তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণাকে জাগিয়ে তুলবে।—যোহন ১২:৩১; মথি ২৪:৯.
২. (ক) ‘জগৎ’ শব্দটিকে বাইবেল কিভাবে ব্যবহার করে? (খ) জগতের প্রতি যিহোবা কিধরনের ভারসাম্যপূর্ণ মনোভাব দেখান?
২ বাইবেলে ‘জগৎ’ (গ্রীক, কসমস) শব্দটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অধার্মিক মনুষ্য সমাজকে আখ্যাত করে যেটি “সেই পাপাত্মার মধ্যে শুইয়া রহিয়াছে।” (১ যোহন ৫:১৯) যেহেতু খ্রীষ্টানেরা যিহোবার মানদণ্ড অনুযায়ী চলে আর এছাড়াও জগতে ঈশ্বরের রাজ্যের সুসমাচার প্রচার করা সম্বন্ধীয় আজ্ঞাকে পালন করে, তাই কখনও কখনও তাদের ও জগতের মধ্যে এক কঠিন সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে। (২ তীমথিয় ৩:১২; ১ যোহন ৩:১, ১৩) কিন্তু, শাস্ত্রে কসমস সাধারণভাবে মনুষ্য পরিবারকে উল্লেখ করার জন্যও ব্যবহৃত হয়েছে। এই অর্থে জগৎ সম্পর্কে বলতে গিয়ে যীশু বলেছিলেন: “ঈশ্বর জগৎকে এমন প্রেম করিলেন যে, আপনার একজাত পুত্ত্রকে দান করিলেন, যেন, যে কেহ তাঁহাতে বিশ্বাস করে, সে বিনষ্ট না হয়, কিন্তু অনন্ত জীবন পায়। কেননা ঈশ্বর জগতের বিচার করিতে পুত্ত্রকে জগতে প্রেরণ করেন নাই, কিন্তু জগৎ যেন তাঁহার দ্বারা পরিত্রাণ পায়।” (যোহন ৩:১৬, ১৭; ২ করিন্থীয় ৫:১৯; ১ যোহন ৪:১৪) সুতরাং, শয়তানের মন্দ জগৎ দ্বারা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বিষয়গুলিকে ঘৃণা করেও, যিহোবা তাঁর পুত্রকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে মানবজাতির প্রতি তাঁর প্রেম প্রদর্শন করেছেন, তাদের সকলকে রক্ষা করার জন্য যারা ‘মনপরিবর্ত্তন পর্য্যন্ত পঁহুছায়।’ (২ পিতর ৩:৯; হিতোপদেশ ৬:১৬-১৯) জগৎ সম্পর্কে যিহোবার ভারসাম্যপূর্ণ মনোভাব দ্বারা তাঁর উপাসকদের নির্দেশিত হওয়া উচিত।
যীশুর উদাহরণ
৩, ৪. (ক) শাসনপদ সম্বন্ধে যীশু কোন্ স্থান গ্রহণ করেছিলেন? (খ) মনুষ্যজাতির জগৎকে যীশু কোন্ দৃষ্টিতে দেখেছিলেন?
৩ তাঁর মৃত্যুর অল্প কিছু পূর্বে, যীশু পন্তীয় পীলাতকে বলেছিলেন: “আমার রাজ্য এ জগতের নয়।” (যোহন ১৮:৩৬) এই বাক্যগুলির সাথে সংগতি রেখে যীশু পূর্বে জগতের রাজ্যগুলির কর্তৃত্ব তাঁকে দিতে চাওয়া সম্বন্ধীয় শয়তানের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন আর তাঁকে রাজা করার জন্য যিহূদীদের প্রচেষ্টাকেও তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। (লূক ৪:৫-৮; যোহন ৬:১৪, ১৫) তবুও, যীশু মনুষ্যজাতির জগতের জন্য মহান প্রেম দেখিয়েছিলেন। প্রেরিত মথি এর একটি উদাহরণ সম্বন্ধে বিবৃতি দিয়েছিলেন: “কিন্তু বিস্তর লোক দেখিয়া তিনি তাহাদের প্রতি করুণাবিষ্ট হইলেন, কেননা তাহারা ব্যাকুল ও ছিন্নভিন্ন ছিল, যেন পালকবিহীন মেষপাল।” প্রেমের দ্বারা পরিচালিত হয়ে, তিনি তাদের শহর ও গ্রামগুলিতে গিয়ে লোকেদের কাছে প্রচার করেছিলেন। তিনি তাদের শিক্ষা দিয়েছিলেন ও তাদের রোগ সুস্থ করেছিলেন। (মথি ৯:৩৬) যারা তাঁর কাছে শিখতে এসেছিল তাদের দৈহিক চাহিদার বিষয়েও তিনি সংবেদনশীল ছিলেন। আমরা পড়ি: “যীশু আপন শিষ্যদিগকে নিকটে ডাকিয়া কহিলেন, এই লোকসমুহের প্রতি আমার করুণা হইতেছে; কেননা ইহারা আজ তিন দিবস আমার সঙ্গে রহিয়াছে, এবং ইহাদের নিকটে খাবার কিছুই নাই; আর আমি ইহাদিগকে অনাহারে বিদায় করিতে ইচ্ছা করি না, পাছে ইহারা পথে মূর্চ্ছা পড়ে।” (মথি ১৫:৩২) কতই না এক প্রেমপূর্ণ উদ্বিগ্নতা!
৪ যিহূদীরা শমরীয়দের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিল কিন্তু যীশু দীর্ঘ সময় ধরে এক শমরীয় নারীর সাথে কথা বলেছিলেন ও শমরীয় শহরে বিস্তারিতভাবে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য দুইদিন অতিবাহিত করেছিলেন। (যোহন ৪:৫-৪২) যদিও ঈশ্বর তাঁকে কেবলমাত্র ‘ইস্রায়েল-কুলের হারান মেষেদের’ কাছে পাঠিয়েছিলেন, যীশু প্রায়ই অন্যান্য ন-যিহূদীদের দ্বারা প্রদর্শিত বিশ্বাসের অভিব্যক্তিগুলিতেও সাড়া দিয়েছিলেন। (মথি ৮:৫-১৩; ১৫:২১-২৮) হ্যাঁ, যীশু প্রদর্শন করেছিলেন যে ‘জগতের অংশ না’ হওয়া ও একই সময়ে মনুষ্যজাতির জগতের প্রতি অর্থাৎ লোকেদের প্রতি প্রেম দেখানো সম্ভব। আমরা যেখানে বাস করি, কাজ করি অথবা কেনাকাটা করি সেখানকার লোকেদের প্রতি কি আমরা অনুরূপ সহানুভূতি দেখিয়ে থাকি? তাদের মঙ্গলের জন্য আমরা কি উদ্বিগ্নতা দেখিয়ে থাকি—কেবলমাত্র তাদের আধ্যাত্মিক চাহিদার বিষয়েই নয় কিন্তু অন্যান্য প্রয়োজনগুলিতেও, যদি তা যুক্তিসংগতভাবে আমাদের সাধ্যের মধ্যে হয়? যীশু তা করেছিলেন আর এটি করার দ্বারা তিনি রাজ্য সম্বন্ধে লোকেদের শিক্ষা দেওয়ার পথ উন্মুক্ত করেছিলেন। সত্য, যে আমরা আক্ষরিকভাবে অলৌকিক কাজগুলি করতে পারি না যেমন যীশু করেছিলেন। কিন্তু প্রায়ই দয়াপূর্ণ কাজ, বলতে গেলে কুসংস্কার ভেঙে ফেলার ক্ষেত্রে অলৌকিকভাবে কাজ করে।
“বহিঃস্থ” লোকেদের প্রতি পৌলের মনোভাব
৫, ৬. প্রেরিত পৌল সেই সমস্ত যিহূদীদের সাথে কিরূপ ব্যবহার করেছিলেন যারা “বহিঃস্থ” ছিল?
৫ তার বিভিন্ন পত্রে প্রেরিত পৌল “বাহিরের” অথবা “বহিঃস্থ” অর্থাৎ ন-খ্রীষ্টীয় লোকেদের বিষয়ে উল্লেখ করেছিলেন তা তারা যিহূদী অথবা পরজাতীয় যাই হোক না কেন। (১ করিন্থীয় ৫:১২; ১ থিষলনীকীয় ৪:১২, NW; ১ তীমথিয় ৩:৭) এইধরনের ব্যক্তিদের সাথে তিনি কিভাবে ব্যবহার করেছিলেন? ‘কতকগুলি লোককে পরিত্রাণ করিবার জন্য তিনি সর্ব্বজনের কাছে সর্ব্ববিধ হইয়াছিলেন।’ (১ করিন্থীয় ৯:২০-২২) যখন তিনি একটি শহরে উপস্থিত হতেন, তার প্রচারের পদ্ধতি ছিল, প্রথমে যিহূদীদের কাছে যাওয়া যারা সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। তার উপস্থাপনা কেমন ছিল? কৌশলী ও শ্রদ্ধাপূর্ণভাবে তিনি প্রত্যয় উৎপন্নকারী বাইবেলের প্রমাণগুলি প্রদান করেছিলেন যে মশীহ এসেছিলেন, বলিদানমূলক মৃত্যু বরণ করেছিলেন এবং পুনরুত্থিত হয়েছিলেন।—প্রেরিত ১৩:৫, ১৪-১৬, ৪৩; ১৭:১-৩, ১০.
৬ এইভাবে পৌল ব্যবস্থা ও ভাববাদীদের সম্বন্ধে যিহূদীদের জ্ঞানকে গঠন করেছিলেন যেন তিনি তাদের মশীহ ও ঈশ্বরের রাজ্য সম্বন্ধে শিক্ষা দিতে পারেন। আর কিছুজনের মধ্যে প্রত্যয় উৎপাদন করার ক্ষেত্রে তিনি সফল হয়েছিলেন। (প্রেরিত ১৪:১; ১৭:৪) যিহূদী নেতাদের দ্বারা বিরোধিতা সত্ত্বেও, পৌল সহযিহূদীদের জন্য আন্তরিক অনুভূতি প্রদর্শন করেছিলেন যখন তিনি লিখেছিলেন: “ভ্রাতৃগণ, আমার হৃদয়ের সুবাসনা এবং তাহাদের [যিহূদীদের] জন্য ঈশ্বরের কাছে বিনতি এই, যেন তাহাদের পরিত্রাণ হয়। কেননা আমি তাহাদের পক্ষে এই সাক্ষ্য দিতেছি যে, ঈশ্বরের বিষয়ে তাহাদের উদ্যোগ আছে, কিন্তু তাহা জ্ঞানানুযায়ী নয়।”—রোমীয় ১০:১, ২.
ন-যিহূদী বিশ্বাসীদের সাহায্য করা
৭. পৌলের প্রচারিত সুসমাচারের প্রতি কিভাবে অনেক ধর্মান্তরিত ব্যক্তিরা সাড়া দিয়েছিলেন?
৭ ধর্মান্তরিত ব্যক্তিরা ন-যিহূদী ছিলেন যারা ছিন্নত্বক যিহূদীবাদ অভ্যাসকারীতে পরিণত হয়েছিলেন। স্পষ্টতই, রোম, সিরিয়া, আন্তিয়খিয়া, ইথিওপিয়া ও পিষিদিয়ার আন্তিয়খিয়া—প্রকৃতই সমগ্র যিহূদী বসবাসকারী অঞ্চলব্যাপী ধর্মান্তরিত ব্যক্তিরা ছিলেন। (প্রেরিত ২:৮-১০; ৬:৫; ৮:২৭; ১৩:১৪, ৪৩; মথি ২৩:১৫ পদের সাথে তুলনা করুন।) অনেক যিহূদী শাসকদের বিপরীতে, ধর্মান্তরিত ব্যক্তিরা সম্ভবত উদ্ধত ছিলেন না আর তারা গর্বিতভাবে নিজেদের অব্রাহামের বংশধর বলে দম্ভ করতে পারতেন না। (মথি ৩:৯; যোহন ৮:৩৩) বরঞ্চ, তারা পৌত্তলিক দেবতাদের পরিত্যাগ করেছিলেন এবং তাঁর ও তাঁর ব্যবস্থা সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞান অর্জন করে নম্রভাবে যিহোবার প্রতি ফিরেছিলেন। আর তারা আগত মশীহ সম্বন্ধে যিহূদী আশাকে গ্রহণ করেছিলেন। সত্য খোঁজার দ্বারা ইতিমধ্যেই পরিবর্তিত হওয়ার ক্ষেত্রে ইচ্ছুক মনোভাব দেখিয়ে তাদের অনেকেই আরও পরিবর্তন করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন ও প্রেরিত পৌলের প্রচারের প্রতি সাড়া দিয়েছিলেন। (প্রেরিত ১৩:৪২, ৪৩) যখন একজন ধর্মান্তরিত ব্যক্তি যিনি একসময় পৌত্তলিক দেবতাদের উপাসনা করতেন, খ্রীষ্টতত্ত্বে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন তিনি একান্তভাবে অন্য পরজাতীয়দের কাছে যারা তখনও সেই সমস্ত দেবতাদের উপাসনা করত, সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য সজ্জিত ছিলেন।
৮, ৯. (ক) ধর্মান্তরিত ব্যক্তিরা ছাড়াও পরজাতীয়দের আর অন্যান্য কোন্ শ্রেণী যিহূদী ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন? (খ) কিভাবে অনেক অচ্ছিন্নত্বক ঈশ্বর ভয়শীল ব্যক্তি সুসমাচারের প্রতি সাড়া দিয়েছিলেন?
৮ ছিন্নত্বক ধর্মান্তরিত ব্যক্তি ছাড়া অন্যান্য ন-যিহূদী ব্যক্তিরাও যিহূদী ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। এই ব্যক্তিদের মধ্যে প্রথম খ্রীষ্টান হয়েছিলেন কর্ণীলিয় যিনি যদিও ধর্মান্তরিত ছিলেন না কিন্তু একজন “ভক্ত ছিলেন, এবং . . . ঈশ্বরকে ভয় করিতেন।” (প্রেরিত ১০:২) প্রেরিত পুস্তকের উপর তার মন্তব্যে অধ্যাপক এফ. এফ. ব্রুশ লিখেছিলেন: “এই পরজাতীয়েরা সাধারণভাবে ‘ঈশ্বর ভয়শীল’ হিসাবে পরিচিত ছিলেন যদিও এটি একটি পরিভাষাগত পদ নয় কিন্তু ব্যবহারের উপযোগী একটি পদ। সেই সময়ের অনেক পরজাতীয়েরা যদিও যিহূদীবাদে সম্পূর্ণভাবে ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না (ত্বকচ্ছেদের দাবি পুরুষদের জন্য এক বিশেষ প্রতিবন্ধকতাস্বরূপ ছিল), যিহূদী ধর্মধামে একেশ্বরবাদ সংক্রান্ত সহজ উপাসনা ও যিহূদী জীবনধারার নীতিগত মান দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তাদের কিছুজন ধর্মধামে উপস্থিত হতেন এবং প্রার্থনা ও শাস্ত্রীয় শিক্ষা সম্বন্ধে কিছুটা অবগত হয়েছিলেন যা তারা গ্রীক সংস্করণের পাঠ থেকে শুনেছিলেন।
৯ প্রেরিত পৌল অনেক ঈশ্বর ভয়শীল ব্যক্তিদের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন যখন তিনি এশিয়া মাইনর ও গ্রীসের ধর্মধামগুলিতে প্রচার করছিলেন। পিষিদিয়ার আন্তিয়খিয়ায় ধর্মধামে সমবেত ব্যক্তিদের তিনি “হে ইস্রায়েল-লোকেরা, হে ঈশ্বরভীতগণ” বলে সম্বোধন করেছিলেন। (প্রেরিত ১৩:১৬, ২৬) লূক লেখেন যে থিষলনীকীয়ার ধর্মধামে তিনটি বিশ্রামবারে পৌল প্রচার করার পর, “তাহাদের মধ্যে কয়েক জন [যিহূদী] প্রত্যয় করিল, [খ্রীষ্টান হল] এবং পৌলের ও সীলের সহিত যোগ দিল; আর ভক্ত গ্রীকদিগের মধ্যে বিস্তর লোক ও অনেকগুলি প্রধান মহিলা তাঁহাদের সহিত যোগ দিলেন।” (প্রেরিত ১৭:৪) সম্ভবত, কিছু গ্রীকেরা অচ্ছিন্নত্বক ঈশ্বর-ভয়শীল ব্যক্তি ছিলেন। এই সম্বন্ধে প্রমাণ আছে যে এইধরনের অনেক পরজাতীয়েরা যিহূদী সমাজের সাথে তাদের মেলামেশা স্থাপন করেছিলেন।
“অবিশ্বাসীদের” মাঝে প্রচার
১০. কিভাবে পৌল পরজাতীয়দের কাছে প্রচার করেছিলেন যাদের কোন শাস্ত্রীয় পটভূমি ছিল না এবং এর ফল কী হয়েছিল?
১০ খ্রীষ্টীয় গ্রীক শাস্ত্রে “অবিশ্বাসীদের” শব্দটি খ্রীষ্টীয় মণ্ডলীর বাইরের সাধারণ লোকেদের নির্দেশ করতে পারে। প্রায়ই এটি পৌত্তলিকদের প্রতি নির্দেশ করে। (২ করিন্থীয় ৪:৪; ৬:১৪; রোমীয় ১৫:৩১; ১ করিন্থীয় ১৪:২২, ২৩) এথেন্সে অনেক অবিশ্বাসী লোকেরা গ্রীক দর্শন দ্বারা শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন যাদের একেবারেই শাস্ত্রীয় পটভূমি ছিল না। এটি কি পৌলকে তাদের কাছে সাক্ষ্য দিতে নিরুৎসাহিত করেছিল? না। কিন্তু, তিনি তার উপস্থাপনাকে তাদের উপযোগী করে তুলেছিলেন। ইব্রীয় শাস্ত্র থেকে সরাসরি উদ্ধৃতি না করে, দক্ষতার সাথে তিনি বাইবেলের ধারণাগুলি উপস্থিত করেছিলেন যা এথেন্সবাসীদের কাছে অপরিচিত ছিল। তিনি কুশলতার সাথে বাইবেল সত্য ও প্রাচীন স্টোয়িক কবিদের দ্বারা প্রকাশিত নির্দিষ্ট কিছু চিন্তাধারার মধ্যে সমতা দেখিয়েছিলেন। আর তিনি সমস্ত মানবজাতির জন্য একমাত্র সত্য ঈশ্বরের ধারণাকে উপস্থিত করেছিলেন, এক ঈশ্বর যিনি ধার্মিকতায় বিচার করবেন এমন এক ব্যক্তির মাধ্যমে যিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন ও পুনরুত্থিত হয়েছিলেন। এইভাবে, এথেন্সবাসীর কাছে পৌল কৌশলীভাবে খ্রীষ্ট সম্বন্ধে প্রচার করেছিলেন। ফল কী হয়েছিল? যদিও অধিকাংশ লোকেরা খোলাখুলিভাবে তাকে উপহাস করেছিল ও সন্দেহ প্রকাশ করেছিল “কোন কোন ব্যক্তি তাঁহার সঙ্গ ধরিল ও বিশ্বাস করিল; তাহাদের মধ্যে আরেয়পাগীয় দিয়নুষিয় এবং দামারী নাম্নী একটী স্ত্রীলোক, ও তাঁহাদের সহিত আর কয়েক জন ছিলেন।”—প্রেরিত ১৭:১৮, ২১-৩৪.
১১. করিন্থ কিধরনের শহর ছিল এবং সেখানে পৌলের প্রচার কাজের ফলাফল কী হয়েছিল?
১১ করিন্থে এক বৃহৎ আয়তন বিশিষ্ট যিহূদী সমাজ ছিল সুতরাং পৌল সেখানকার ধর্মধামে প্রচার করার দ্বারা তার পরিচর্যা শুরু করেছিলেন। কিন্তু যখন যিহূদীরা বিরোধিতা করতে শুরু করে তখন পৌল পরজাতীয় বসবাসকারী এলাকায় চলে যান। (প্রেরিত ১৮:১-৬) আর কতই না বৃহৎ জনবসতি! করিন্থ এক ব্যস্ত, সংকীর্ণতামুক্ত, ব্যবসায়িক শহর ছিল আর সমগ্র গ্রীক অধ্যুষিত রোমীয় জগতে অনৈতিক জীবনযাপনের জন্য কুখ্যাত ছিল। বাস্তবিকই “করিন্থীয়করণের” অর্থ ছিল অনৈতিক কাজ করা। তবুও, যিহূদীদের দ্বারা পৌলের প্রচার প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরই খ্রীষ্ট তার সম্মুখে আবির্ভূত হয়েছিলেন ও বলেছিলেন: “ভয় করিও না, বরং কথা বল, . . . কেননা এই নগরে আমার অনেক প্রজা আছে।” (প্রেরিত ১৮:৯, ১০) সেটিই ঘটেছিল, পৌল করিন্থে এক মণ্ডলী স্থাপন করেছিলেন এমনকি যদিও এর কিছুজন সদস্য পূর্বে এক “করিন্থীয়” জীবনধারা যাপন করত।—১ করিন্থীয় ৬:৯-১১.
আজকে “সমুদয় মনুষ্যের” পরিত্রাণের চেষ্টা
১২, ১৩. (ক) কিভাবে আজকে আমাদের এলাকা পৌলের দিনের অনুরূপ? (খ) সেই সমস্ত এলাকাগুলির প্রতি আমরা কিধরনের মনোভাব প্রদর্শন করি যেখানে খ্রীষ্টীয় জগতের ধর্মগুলি দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে অথবা যেখানে অধিকাংশেরা সংগঠিত ধর্মের দ্বারা বিভ্রান্ত?
১২ প্রথম শতাব্দীর মত আজকেও, “ঈশ্বরের অনুগ্রহ . . . সমুদয় মনুষ্যের জন্য পরিত্রাণ আনয়ন করে।” (তীত ২:১১) সুসমাচার প্রচারের ক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছে যা সমস্ত মহাদেশ ও অধিকাংশ সমুদ্র দ্বীপগুলিকে আচ্ছাদিত করে। আর পৌলের দিনের মত বাস্তবিকই “সমুদয় মনুষ্যের” সম্মুখবর্তী হওয়া গিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের কিছুজন এমন দেশগুলিতে প্রচার করেন যেখানে খ্রীষ্টীয় জগতের গির্জাগুলি বহু শতাব্দী ধরে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। প্রথম শতাব্দীর যিহূদীদের মত তাদের সদস্যেরাও হয়ত দৃঢ়ভাবে ধর্মীয় পরম্পরাগত রীতিগুলি দ্বারা আবদ্ধ। তবুও, আমরা সেই সমস্ত উত্তম হৃদয়বিশিষ্ট লোকেদের খুঁজে পেতে ও তাদের যেটুকু বাইবেলের জ্ঞান আছে তাকে বাড়িয়ে তুলতে খুশি। এমনকি যদিও তাদের ধর্মীয় নেতারা কখনও কখনও বিরোধিতা করে ও আমাদের উপর তাড়না নিয়ে আসে আমরা তাদের অপমান অথবা অবজ্ঞা করি না। বরঞ্চ, আমরা উপলব্ধি করি যে যদিও যথার্থ জ্ঞানের অভাব রয়েছে তবু তাদের মধ্যে কিছুজনের “ঈশ্বরের বিষয়ে . . . উদ্যোগ আছে।” যীশু এবং পৌলের মত আমরা লোকেদের জন্য অকৃত্রিম প্রেম দেখাই আর তারা যেন পরিত্রাণ পায় এইজন্য আমাদের আকুল আকাঙ্ক্ষা রয়েছে।—রোমীয় ১০:২.
১৩ প্রচার করার সময় আমাদের অনেকেই এমন ব্যক্তিবিশেষদের সাক্ষাৎ পাই যারা সংগঠিত ধর্মের দ্বারা বিভ্রান্ত। কিন্তু তারা হয়ত তবুও ঈশ্বর-ভয়শীল, কিছুমাত্রায় ঈশ্বরে বিশ্বাস করে আর উন্নত জীবন যাপন করতে চেষ্টা করে। এই বিকৃত ও বর্ধিতভাবে ঈশ্বরবিহীন বংশে সেই লোকেদের সাথে সাক্ষাৎ পেয়ে আমাদের কি আনন্দিত হওয়া উচিত নয়, যাদের ঈশ্বরের প্রতি কিছু পরিমাণ বিশ্বাস আছে? আর আমরা কি তাদের এমন এক ধরনের উপাসনার প্রতি পরিচালিত করতে আগ্রহী নই যা কপটতা ও মিথ্যাচার দ্বারা চিহ্নিত নয়?—ফিলিপীয় ২:১৫.
১৪, ১৫. কিভাবে এক বৃহৎ ক্ষেত্র সুসমাচার প্রচারের জন্য প্রাপ্তিসাধ্য?
১৪ টানা জাল সম্বন্ধীয় তাঁর দৃষ্টান্তে যীশু ভাববাণী করেছিলেন যে প্রচার কাজের জন্য এক বিস্তৃত এলাকা থাকবে। (মথি ১৩:৪৭-৪৯) এই দৃষ্টান্তটিকে ব্যাখ্যা করে ১৯৯২ সালের সেপ্টেম্বর ১, প্রহরীদুর্গ এর ২২ পৃষ্ঠা উল্লেখ করেছিল: “শতাব্দী ধরে খ্রীষ্টীয় জগতের সদস্যেরা ঈশ্বরের বাক্য অনুবাদ করতে, কপি করতে এবং তা বিতরণ করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। গির্জাগুলি পরে হয় বাইবেল সমিতিগুলি গড়ে তোলে না হয়ত তাকে সমর্থন করে, যা বাইবেলকে অদূর দেশের ভাষাগুলিতে ভাষান্তরিত হতে সাহায্য করে। তারা মেডিকেল মিশনারীদের ও শিক্ষকদের বাইরে পাঠায়, যারা খাদ্যের বিনিময়ে খ্রীষ্টান তৈরি করে। তা একত্র করে এক বিরাট পরিমাণ অযোগ্য মাছ, যাদের প্রতি ঈশ্বরের অনুমোদন ছিল না। কিন্তু তা লক্ষ লক্ষ ন-খ্রীষ্টীয় ব্যক্তিদের বাইবেল ও এক ধরনের খ্রীষ্টতত্ত্বের প্রতি উন্মুক্ত করে, যা ছিল যদিও দূষিত।”
১৫ খ্রীষ্টীয় জগতের দ্বারা ধর্মান্তরিতকরণ দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা এবং সমুদ্রের কিছু দ্বীপগুলির ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তারকারী হয়েছে। আমাদের দিনে এই অঞ্চলগুলিতে অনেক মৃদুশীল ব্যক্তিরা বসবাস করে আর আমরা ক্রমাগত আরও অধিক উত্তম কাজ করে চলতে পারি যদি আমাদের এইধরনের নম্র ব্যক্তিদের প্রতি এক ইতিবাচক, প্রেমপূর্ণ মনোভাব থাকে, যেমন যিহূদী ধর্মান্তরিত ব্যক্তিদের প্রতি পৌলের ছিল। এই সমস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে যাদের আমাদের সাহায্যের প্রয়োজন সেই লক্ষ লক্ষ ব্যক্তিরা আছে যাদের যিহোবার সাক্ষীদের প্রতি “সহানুভূতিপূর্ণ” বলে আখ্যাত করা যেতে পারে। তারা সর্বদা আমাদের দেখে আনন্দিত হন যখন আমরা তাদের সাথে সাক্ষাৎ করি। তাদের কিছুজন আমাদের সাথে বাইবেল অধ্যয়ন করেছেন আর আমাদের সভাগুলিতে উপস্থিত হয়েছেন বিশেষ করে খ্রীষ্টের মৃত্যুর বাৎসরিক স্মরণার্থক সভায়। এইধরনের ব্যক্তিরা কি রাজ্যের সুসমাচার প্রচার করার জন্য এক বৃহৎ ক্ষেত্রকে প্রতিনিধিত্ব করে না?
১৬, ১৭. (ক) কোন্ প্রকার লোকেদের কাছে আমরা সুসমাচার নিয়ে উপস্থিত হই? (খ) বিভিন্ন প্রকার লোকেদের কাছে প্রচার করার ক্ষেত্রে কিভাবে আমরা পৌলকে অনুকরণ করতে পারি?
১৬ এছাড়াও, তাদের সম্বন্ধে কী যারা খ্রীষ্টীয় জগতের বাইরের সংস্কৃতি থেকে আসেন—আমরা তাদের স্বদেশেই তাদের সাথে সাক্ষাৎ করি অথবা তারা পশ্চিমের দেশগুলিতে প্রবাসীই হোন না কেন? আর সেই সমস্ত কোটি কোটি লোকেদের সম্বন্ধেই বা কী যারা সম্পূর্ণভাবে ধর্মের প্রতি বিমুখ হয়েছেন ও নাস্তিক বা অজ্ঞেয়বাদীতে পরিণত হয়েছেন? এছাড়াও তাদের সম্বন্ধে কী যারা ধর্মীয় উত্তাপে মগ্ন হয়ে আধুনিক দর্শনবিদ্যা ও জনপ্রিয় মনোবিদ্যার প্রতি মনোযোগী হন যেগুলি পুস্তকালয়ে দেখতে পাওয়া অসংখ্য আত্ম-সাহায্যকারী বইগুলিতে প্রকাশিত হয়ে থাকে? এইধরনের ব্যক্তিদের একজনকেও কি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয় বলে বিবেচনা করে অবজ্ঞা করা উচিত? যদি আমরা প্রেরিত পৌলকে অনুকরণ করি তাহলে না।
১৭ যখন তিনি এথেন্সে প্রচার করছিলেন পৌল তার শ্রোতাদের সাথে দর্শন সম্বন্ধীয় তর্কের ফাঁদে পড়েননি। কিন্তু বাইবেলের সত্যকে পরিষ্কার ও যুক্তিপূর্ণ উপায়ে উপস্থিত করে যে লোকেদের সাথে তিনি কথা বলছিলেন তাদের উপযোগী করে তার যুক্তিকে উপস্থাপিত করেছিলেন। অনুরূপভাবে, আমরা যে লোকেদের কাছে প্রচার করি তাদের ধর্ম বা দর্শনগুলিতে আমাদের বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমরা আমাদের সাক্ষ্যদানকে কার্যকারী করার জন্য আমাদের উপস্থাপনাকে তাদের উপযোগী করে তুলি, ফলে আমরা “সর্ব্বজনের কাছে সর্ব্ববিধ” হই। (১ করিন্থীয় ৯:২২) কলসীয় খ্রীষ্টানদের উদ্দেশ্যে লেখার সময় পৌল উল্লেখ করেছিলেন: “তোমরা বাহিরের লোকদের প্রতি বুদ্ধিপূর্ব্বক আচরণ কর, সুযোগ কিনিয়া লও। তোমাদের বাক্য সর্ব্বদা অনুগ্রহ সহযুক্ত হউক, লবণে আস্বাদযুক্ত হউক, কাহাকে কেমন উত্তর দিতে হয়, তাহা যেন তোমরা জানিতে পার।” (বাঁকা অক্ষরে মুদ্রণ আমাদের।)—কলসীয় ৪:৫, ৬.
১৮. আমাদের কোন্ দায়িত্ব রয়েছে এবং কোন্ বিষয়টি আমাদের কখনও ভুলে যাওয়া উচিত নয়?
১৮ যীশু ও প্রেরিত পৌলের মত আসুন আমরা সর্বপ্রকার লোকেদের প্রতি প্রেম প্রদর্শন করি। বিশেষ করে, আসুন আমরা অন্যদের সাথে রাজ্যের সুসমাচার বন্টন করার জন্য নিজেদের প্রয়োগ করি। অপরপক্ষে, আমরা কখনও ভুলে যাব না যে যীশু তাঁর শিষ্যদের সম্পর্কে বলেছিলেন: “তাহারা জগতের নয়।” (যোহন ১৭:১৬) এটি আমাদের জন্য কী অর্থ রাখে, পরবর্তী প্রবন্ধে আমরা সে সম্বন্ধে আরও বিবেচনা করব।
পুনরালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে
◻ জগতের প্রতি যীশুর ভারসাম্যপূর্ণ মনোভাব সম্বন্ধে বর্ণনা করুন।
◻ কিভাবে প্রেরিত পৌল যিহূদী ও ধর্মান্তরিতদের কাছে প্রচার করেছিলেন?
◻ কিভাবে পৌল ঈশ্বর ভয়শীল ও অবিশ্বাসী লোকেদের কাছে উপস্থিত হয়েছিলেন?
◻ আমাদের প্রচার কাজে কিভাবে আমরা “সর্ব্বজনের কাছে সর্ব্ববিধ” হতে পারি?
[১০ পৃষ্ঠার চিত্র]
তাদের প্রতিবেশীদের প্রতি দয়াপূর্ণ কাজগুলি সম্পাদন করে খ্রীষ্টানেরা প্রায়ই কুসংস্কার ভেঙে দিতে পারে