অনীষিফর—একজন নির্ভীক সান্ত্বনাকারী
“আপনাদিগকে সহবন্দি জানিয়া বন্দিগণকে স্মরণ করিও, . . . দুর্দ্দশাপন্ন সকলকে স্মরণ করিও।” (ইব্রীয় ১৩:৩) প্রায় সা.কা. ৬১ সালে প্রেরিত পৌল যখন এই বাক্যগুলি লিখেছিলেন, তিনি নিজে ইতিমধ্যেই একাধিকবার কারাবরণ ভোগ করেছিলেন এবং একজন শহীদ হিসাবে তার মৃত্যুর পূর্বে আরও একবার তা ভোগ করতে চলেছিলেন। (প্রেরিত ১৬:২৩, ২৪; ২২:২৪; ২৩:৩৫; ২৪:২৭; ২ করিন্থীয় ৬:৫; ২ তীমথিয় ২:৯; ফিলীমন ১) যারা তাদের বিশ্বাসের জন্য পরীক্ষা ভোগ করছে সেই সহ বিশ্বাসীদের যত্ন নেওয়ার জন্য মণ্ডলীগুলির পক্ষে সেই সময় তৎপরতার প্রয়োজন ছিল যেমন এটি আজও রয়েছে।
সেই প্রয়োজনের প্রতি প্রথম শতাব্দীর একজন শিষ্য, অনীষিফর বিশেষভাবে মনোযোগী ছিলেন। রোমে, পৌলের দ্বিতীয় কারাবরণকালে তিনি তার সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। তার সম্পর্কে প্রেরিত লিখেছিলেন: “প্রভু অনীষিফরের পরিবারকে দয়া প্রদান করুন, কেননা তিনি বার বার আমার প্রাণ জুড়াইয়াছেন, এবং আমার শৃঙ্খল হেতু লজ্জিত হন নাই; বরং তিনি রোমে উপস্থিত হইলে যত্নপূর্ব্বক অনুসন্ধান করিয়া আমার সঙ্গে দেখা করিয়াছিলেন।” (২ তীমথিয় ১:১৬, ১৭) এই কতিপয় বাক্যগুলির প্রকৃত অর্থ কী সে বিষয়ে চিন্তা করার জন্য আপনি কি কখনও সময় করে নিয়েছেন? তা করা সম্ভবত অনীষিফরের প্রতি আপনার উপলব্ধিবোধকে বৃদ্ধি করবে। আপনি দেখতে পাবেন যে তিনি ছিলেন একজন নির্ভীক সান্ত্বনাকারী।
পৌলের দ্বিতীয় কারাবরণ
তার প্রথম কারাবরণ থেকে মুক্তিলাভের পর, পৌল পুনরায় রোমের একটি জেলে ছিলেন কিন্তু ভিন্ন পরিস্থিতিতে। তার প্রথম কারাবরণকালে তার বন্ধুরা তার নিজস্ব ভাড়াকৃত গৃহে আসতেন আর মনে হয় যেন তিনি এই বিষয়ে প্রত্যয়ী ছিলেন যে মুক্তি আসন্ন ছিল। এখন অধিকাংশের দ্বারা পরিত্যক্ত হয়ে শহীদ হওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছিল।—প্রেরিত ২৮:৩০; ২ তীমথিয় ৪:৬-৮, ১৬; ফিলীমন ২২.
এই সময়ে প্রায় সা.কা. ৬৫ সালে পৌল কারাগারে ছিলেন। আনুমানিক, এক বছর পূর্বে—সা.কা. ৬৪ সালের জুলাই মাসে—রোমের মধ্যে দিয়ে আগুন বয়ে যায় এবং শহরটির ১৪টির মধ্যে ১০টি অঞ্চলকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। রোমীয় ইতিহাসবেত্তা টেসিটাসের মতানুসারে, সম্রাট নিরো “অগ্নি যে তার নিজেরই আদেশের ফল এই অশুভ বিশ্বাসকে দূর করতে” অসমর্থ ছিলেন। ফলে, নিজের দোষ ঢাকবার জন্য নিরো এমন একটি শ্রেণীর উপর অপবাদ ও নিদারুণ অত্যাচার আনেন যারা তাদের কাজের জন্য ঘৃণিত ছিল, জনসাধারণ্যে যারা খ্রীষ্টান হিসাবে আখ্যাত ছিল। . . . সর্বপ্রকার বিদ্রূপ তাদের মৃত্যুকে আরও ভয়ানক করে তোলে। পশুর চামড়া দিয়ে ঢেকে তাদের কুকুর দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে হত্যা করা হয় অথবা ক্রুশে পেরেক দিয়ে বিদ্ধ করা হয় অথবা যখন দিনের আলো নিঃশেষ হয়ে যেত তখন রাতকে আলোকিত করার জন্য তাদের আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল।”
এইরকমই একটি পরিস্থিতিতে আর অনুরূপ সম্ভাবনার মধ্যে পৌল পুনরায় নিজেকে কারাগারে দেখতে পান। আশ্চর্যের বিষয় নয় যে তার বন্ধু অনীষিফরের সাক্ষাতের জন্য তিনি খুবই কৃতজ্ঞ ছিলেন! কিন্তু আসুন অনীষিফরের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমরা এই একই পরিস্থিতির প্রতি দৃষ্টিপাত করি।
কারারুদ্ধ পৌলের সাথে সাক্ষাৎ করা
সম্ভবত, অনীষিফরের পরিবার ইফিষে বাস করত। (২ তীমথিয় ১:১৮; ৪:১৯) অনীষিফর তার নিজের কোন কাজের জন্য অথবা বিশেষভাবে পৌলের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য সাম্রাজ্যের রাজধানীতে এসেছিলেন সে বিষয়ে কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। যাই হোক না কেন, প্রেরিত মন্তব্য করেছিলেন: ‘বরং অনীষিফর রোমে উপস্থিত হইলে, তিনি বার বার আমার প্রাণ জুড়াইতেন [“সতেজ করতেন,” NW]।’ (২ তীমথিয় ১:১৬, ১৭) কিধরনের সতেজতা? যদিও অনীষিফরের সহযোগিতা হয়ত বস্তুগত সাহায্যকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল কিন্তু স্পষ্টভাবেই তার উপস্থিতি পৌলকে শক্তিশালী এবং উৎসাহিত করার জন্য শক্তিদায়ক ঔষধি হিসাবে কাজ করেছিল। বস্তুতপক্ষে, কোন কোন অনুবাদ এইভাবে পড়া হয়: “তিনি প্রায়ই আমার আত্মাকে আনন্দিত করেছেন” অথবা “তিনি প্রায়ই আমাকে সান্ত্বনা প্রদান করেছেন।”
সেই সময়ে রোমের কারাগারে একজন খ্রীষ্টানের সাথে সাক্ষাতের ইচ্ছা পূর্ণ করা প্রতিদ্বন্দ্বিতা উপস্থিত করত। পৌলের প্রথম কারাবরণের সময়ের বৈসাদৃশ্যে রোমীয় খ্রীষ্টানেরা স্পষ্টতই তার সাথে সান্নিধ্য বজায় রাখতে পারেনি। রোমের মত একটি বৃহৎ শহরে, সেই বৃহৎ সংখ্যক কারাবাসীদের মাঝে যারা ভিন্ন ভিন্ন অপরাধে কারারুদ্ধ ছিল, অজানা একজন কারাবাসীকে খুঁজে বের করা সহজ কাজ ছিল না। তাই, পরিশ্রমসাপেক্ষ সন্ধানের প্রয়োজন ছিল। পণ্ডিত জোভাননি রোস্টানো এইভাবে বিষয়টি বর্ণনা করেন: “হয়ত সমস্যাগুলির প্রকারভেদ ছিল। সর্বোপরি, সন্ধানের জন্য অসাধারণ ঝুঁকির প্রয়োজন ছিল। এখান ওখান থেকে তথ্য সংগ্রহ করা এবং সেই জেলের অবস্থান খুঁজে বের করার জন্য উদ্বিগ্ন হওয়াকে প্রকাশ করা যেখানে অসংখ্য অপরাধের সাথে যুক্ত একজন গোঁড়া পুরনো কয়েদি বন্দী রয়েছে হয়ত অসংগত সন্দেহকে জাগিয়ে তুলত।”
এই একই পরিস্থিতি সম্বন্ধে এই বলে লেখক পি. এন. হ্যারিসন একটি উজ্জ্বল চিত্র তুলে ধরেন: “মনে হয় এক বিশাল জনস্রোতের মাঝে আমরা একটি উদ্দেশ্যভরা ব্যক্তির মুখের এক ঝলক দেখতে পেয়েছি, যে আগুন্তুকটিকে সুদূর এজিয়েন উপকূল থেকে চাঞ্চল্যকর আগ্রহ নিয়ে আমরা অনুসরণ করে চলেছি, যখন সে অপরিচিত রাস্তার গোলকধাঁধাকে ভেদ করে এগিয়ে চলেছে, একাধিক দরজায় কড়া নেড়েছে, প্রতিটি সূত্রের অনুধাবন করছে, ঝুঁকির আশঙ্কা পেয়েও তার প্রচেষ্টা থেকে বিচ্যুত হইনি; যতক্ষণ না পর্যন্ত একটি অন্ধকারময় কারাগৃহের মধ্যে থেকে পরিচিত এক কণ্ঠস্বর তাকে সম্ভাষণ জানান আর তিনি রোমীয় সৈন্যের অধীনে শৃঙ্খলাবদ্ধ পৌলকে আবিষ্কার করেন।” যদি এই স্থানটিও রোমের অন্যান্য জেলের মত হয়, তাহলে তা সম্ভবত এক শীতল, অন্ধকার এবং নোংরা স্থান ছিল, যেখানে শৃঙ্খল ও সবধরনের উৎপীড়নই বিদ্যমান।
পৌলের মত একজন কয়েদির বন্ধু রূপে শনাক্তিকৃত হওয়া ঝুঁকিবহুল ছিল। এমনকি তার সাথে ক্রমাগত সাক্ষাৎ করে চলা আরও বেশি বিপদজনক ছিল। নিজেকে প্রকাশ্যে একজন খ্রীষ্টান হিসাবে শনাক্তিকরণের অর্থ ছিল গ্রেপ্তার হওয়া ও যাতনা দ্বারা মৃত্যুর ঝুঁকিকে গ্রহণ করা। কিন্তু অনীষিফর কেবলমাত্র এক কিংবা দুইবার পরিদর্শন করেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। “বার বার” তা করতে তিনি লজ্জিত কিংবা ভীত ছিলেন না। বিপদ সত্ত্বেও নির্ভীকতা এবং প্রেমপূর্ণ সহযোগিতা প্রদান করে অনীষিফর সত্যই তার নামের অর্থ “লাভ আনয়নকারী” অনুসারে জীবনযাপন করেছিলেন।
কেন অনীষিফর এই সমস্ত কিছু করেছিলেন? ব্রায়ান রেপস্কি উল্লেখ করেন: “কারাগার কেবলমাত্র শারীরিক কষ্টভোগের একটি স্থানই নয় কিন্তু কয়েদির জন্য যে নিষ্পেষণ এটি নিয়ে আসত সেই কারণে এটি এক প্রগাঢ় উদ্বিগ্নতার স্থানও ছিল। এইধরনের এক পরিস্থিতির ক্ষেত্রে, সাহায্যকারীদের শারীরিক উপস্থিতি এবং মৌখিক উৎসাহ প্রদান আবেগগত দিক দিয়ে এক কয়েদির কাছে মহা শক্তিপ্রদানকারী হতে পারত।” অনীষিফর স্পষ্টভাবেই তা উপলব্ধি করেছিলেন এবং নির্ভীকতার সাথে তার বন্ধুকে সমর্থন যুগিয়েছিলেন। সম্ভবত এই সাহায্যকে পৌল কতই না উপলব্ধি করেছিলেন!
অনীষিফরের কী হয়েছিল?
তীমথিয়ের উদ্দেশ্যে তার দ্বিতীয় পত্রে, পৌল অনীষিফরের গৃহে শুভেচ্ছা পাঠিয়েছিলেন এবং তার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন: “প্রভু তাঁহাকে এই বর দিউন, যেন সেই দিন তিনি প্রভুর [“যিহোবার,” NW] নিকট দয়া পান।” (২ তীমথিয় ১:১৮; ৪:১৯) অনেকে মনে করে যে “সেই দিন” এই বাক্যগুলি ঈশ্বরের বিচার দিনকে নির্দেশ করে আর তাই উপসংহার করা হয় যে অনীষিফর মারা গিয়েছিলেন। তাই যদি হয়, তাহলে সম্ভবত “অনীষিফর তার শেষ সাক্ষাতের সময় ধরা পড়েছিলেন এবং এর মূল্য পরিশোধ করেছিলেন . . . তার জীবন দিয়ে” পি. এন. হ্যারিসন উল্লেখ করেন। অবশ্যই, অনীষিফর হয়ত সাধারণভাবে গৃহ থেকে দূরে ছিলেন অথবা পৌল হয়ত তার সমগ্র পরিবারের কাছে শুভেচ্ছা পাঠানোর সময় তাকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।
কেউ কেউ মনে করে যে এই উক্তিটির মধ্যে বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে: “প্রভু তাঁহাকে এই বর দিউন, যেন সেই দিন তিনি যিহোবার নিকট দয়া পান।” তারা মনে করে যে এই বাক্যগুলি জীবিত এবং সম্ভবত কোন আধ্যাত্মিক অঞ্চলে কষ্টভোগ করছে এমন প্রস্থানরত প্রাণের জন্য মধ্যস্থতামূলক প্রার্থনাকে সমর্থন করে। কিন্তু, এইধরনের একটি ধারণা শাস্ত্রীয় শিক্ষার সাথে সংঘর্ষ ঘটায় যা বলে মৃতেরা কিছুই জানে না। (উপদেশক ৯:৫, ১০) এমনকি যদি অনীষিফর মারা গিয়েও থাকেন, পৌল সাধারণভাবে এই কামনা প্রকাশ করছিলেন যে তার বন্ধু যেন ঈশ্বরের কাছ থেকে দয়া লাভ করে। “সকলের জন্য এই কামনা প্রকাশ করার অধিকার আমাদের রয়েছে,” বলেন আর. এফ. হরটন। “কিন্তু মৃতদের জন্য প্রার্থনা করা আর তাদের উদ্দেশ্যে পিণ্ডী অর্পণ করা, এমন একটি চিন্তা যা [প্রেরিতের] মনের অনেক দূরে ছিল।”
আসুন আমরা নিষ্ঠাবান সান্ত্বনাকারী হই
পৌলকে সহযোগিতা করার সময়ে অনীষিফর প্রকৃতপক্ষে তার জীবন হারান বা নাই হারান, নিশ্চিতরূপে তিনি প্রেরিতকে খুঁজতে ও কারাগারে তার সাথে সাক্ষাৎ করতে ঝুঁকি নিয়েছিলেন। আর অনীষিফরের কাছ থেকে পৌল যে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সমর্থন এবং উৎসাহ পেয়েছিলেন তিনি যে তা উপলব্ধি করেছিলেন তাতে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না।
যখন সহখ্রীষ্টানেরা পরীক্ষা, নির্যাতন অথবা কারাবরণ ভোগ করে, তখন আমরা হয়ত তাদের সান্ত্বনা ও উৎসাহ প্রদান করার মত উপযুক্ত অবস্থানে থাকি। তাই আমরা যেন তাদের জন্য প্রার্থনা করি এবং প্রেমের সাথে তাদের সাহায্য করার জন্য আমরা যা করতে পারি তার সবটুকু করি। (যোহন ১৩:৩৫; ১ থিষলনীকীয় ৫:২৫) অনীষিফরের মত, আসুন আমরা নির্ভীক সান্ত্বনাকারী হই।
[৩১ পৃষ্ঠার চিত্র]
অনীষিফর নির্ভীকতার সাথে কারাবন্দী প্রেরিত পৌলকে সান্ত্বনা যুগিয়েছিলেন