তাদের বিশ্বাস অনুকরণ করুন
তিনি প্রার্থনায় ঈশ্বরের কাছে তার হৃদয় উজাড় করে দিয়েছিলেন
তার মনকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টায় হান্না যাত্রার প্রস্তুতিতে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন। এটা একটা আনন্দের সময় হওয়া উচিত ছিল; তার স্বামী ইল্কানা শীলোতে আবাসে উপাসনা করার জন্য এই বার্ষিক যাত্রাগুলোতে রীতিগতভাবে পুরো পরিবারকে নিয়ে যেতেন। যিহোবা চেয়েছিলেন এই উপলক্ষ্যগুলো যেন আনন্দপূর্ণ হয়ে ওঠে। (দ্বিতীয় বিবরণ ১৬:১৫) আর নিঃসন্দেহে, হান্না তার শৈশবকাল থেকেই এই উৎসবগুলোতে আনন্দ পেতেন। কিন্তু সম্প্রতি বছরগুলোতে তার ক্ষেত্রে বিষয়গুলো পরিবর্তিত হয়েছে।
তিনি এমন একজন স্বামী পেয়ে আশীর্বাদপ্রাপ্ত হয়েছিলেন, যিনি তাকে ভালোবাসতেন। কিন্তু, ইল্কানার আরেকটা স্ত্রী ছিল। তার নাম ছিল পনিন্না আর মনে হয় হান্নার জীবন অতিষ্ঠ করে তোলার জন্য তিনি সবসময় লেগে থাকতেন। পনিন্না এমনকী হান্নার জন্য এই বার্ষিক উপলক্ষ্যগুলোকেও নিদারুণ যন্ত্রণার এক উৎস করে তোলার জন্য এক উপায় খুঁজে বের করেছিলেন। কীভাবে? আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, কীভাবে যিহোবার প্রতি হান্নার বিশ্বাস তাকে সেই পরিস্থিতির সঙ্গে সফলভাবে মোকাবিলা করতে সাহায্য করেছিল, যেটাকে প্রায়ই নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব বলে মনে হয়েছিল? আপনি যদি এমন প্রতিদ্বন্দ্বিতাগুলোর মুখোমুখি হন, যেগুলো আপনার জীবনে আনন্দ কেড়ে নেয়, তাহলে আপনি হয়তো হান্নার বিবরণকে বিশেষ করে অনুপ্রেরণাদায়ক বলে মনে করবেন।
“তোমার মন শোকাকুল কেন?”
বাইবেল হান্নার জীবনে দুটো বড়ো সমস্যা সম্বন্ধে প্রকাশ করে। প্রথমটার ওপর তার সামান্যই নিয়ন্ত্রণ ছিল আর দ্বিতীয়টার ওপর একেবারেই কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। প্রথমত, তিনি বহুগামী বিবাহে আবদ্ধ ছিলেন আর তার সপত্নী তাকে ঘৃণা করতেন। দ্বিতীয়ত, তিনি বন্ধ্যা ছিলেন। এই পরিস্থিতি যেকোনো স্ত্রীর জন্য কঠিন, যিনি একটা সন্তান লাভের জন্য আকুল আকাঙ্ক্ষী; কিন্তু হান্নার সময়ে ও সংস্কৃতিতে এটা প্রচণ্ড দুঃখের এক কারণ ছিল। প্রত্যেক পরিবার তাদের পারিবারিক নাম বজায় রাখার জন্য বংশধরের ওপর নির্ভর করত। বন্ধ্যাত্বকে অত্যন্ত নিন্দনীয় ও লজ্জাজনক বিষয় হিসেবে দেখা হতো।
পনিন্না যদি কষ্ট না দিতেন, তাহলে হান্না নিশ্চয় সফলতার সঙ্গে তার পরিস্থিতিকে সহ্য করতেন। বহুগামিতা কখনোই এক আদর্শ পরিস্থিতি ছিল না। প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বিবাদ ও মর্মবেদনা এই সমস্ত খুবই সাধারণ বিষয় ছিল। এই অভ্যাস একবিবাহ সম্বন্ধীয় মান থেকে একেবারে আলাদা ছিল, যেটি ঈশ্বর এদন উদ্যানে স্থাপন করেছিলেন।a (আদিপুস্তক ২:২৪) এভাবে, বাইবেল বহুগামিতা সম্বন্ধে এক নির্মম চিত্র তুলে ধরে আর ইল্কানার পরিবারকে ঘিরে জীবনের দুঃখজনক ছবিটা হল, সেই চিত্রে তাৎপর্যপূর্ণ তুলির ছোঁয়াগুলোর মধ্যে একটা।
আপনি বুঝতে পারবেন যে, ইল্কানা হান্নাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। যিহুদি রীতি অনুসারে, তিনি প্রথমে হান্নাকে এবং কয়েক বছর পরে পনিন্নাকে বিয়ে করেছিলেন। যা-ই হোক না কেন, পনিন্না যিনি হান্নার প্রতি খুবই ঈর্ষান্বিত ছিলেন, তিনি তার সতীনকে কষ্ট দেওয়ার জন্য বিভিন্ন উপায় খুঁজে নিয়েছিলেন। হান্নার চেয়ে পনিন্নার সবচেয়ে বড়ো সুযোগটা ছিল জন্মদানের ক্ষমতা। পনিন্না একের পর এক সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন আর প্রতিটা সন্তান জন্ম দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার আত্ম-গৌরব বৃদ্ধি পেয়েছিল। হান্নার জন্য দুঃখিত হওয়ার এবং তার হতাশার জন্য তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার পরিবর্তে, পনিন্না সেই সংবেদনশীলতার অনুভূতি নিয়ে খেলা করেছিলেন। বাইবেল বলে যে, “তাঁহার মনস্তাপ জন্মাইবার চেষ্টায়” পনিন্না তাকে বিরক্ত করতেন। (১ শমূয়েল ১:৬) পনিন্না জেনেশুনেই তা করতেন। তিনি হান্নাকে আঘাত দিতে চেয়েছিলেন আর তিনি সফলও হয়েছিলেন।
মনে হয় যে, শীলোতে বার্ষিক যাত্রার সময়ে পনিন্নার অনুকূল সুযোগটা এসেছিল। ইল্কানা পনিন্নার অনেক সন্তানের প্রত্যেককে—“তাঁহার সমস্ত পুত্ত্রকন্যাকে”—যিহোবার কাছে উৎসর্গীকৃত বলির অংশগুলো দিতেন। কিন্তু, সন্তানহীনা হান্না কেবল তার নিজের অংশটুকুই পেতেন। এরপর পনিন্না হান্নার ওপর এতই আধিপত্য করতেন ও তাকে তার বন্ধ্যাত্ব সম্বন্ধে মনে করিয়ে দিতেন যে, বেচারি মহিলাটি কান্নায় ভেঙে পড়তেন আর এমনকী খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিতেন। যেহেতু ইল্কানা তাকে সাহায্য করতে পারতেন না অথচ তার কাছে এটা স্পষ্ট ছিল যে, হান্না দুঃখার্ত ছিলেন আর খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন, তাই তিনি তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, “হান্না, কেন কাঁদিতেছ? কেন ভোজন করিতেছ না? তোমার মন শোকাকুল কেন? তোমার কাছে দশ পুত্ত্র হইতেও কি আমি উত্তম নহি?”—১ শমূয়েল ১:৪-৮.
হান্নার দুঃখের কারণ ছিল তার বন্ধ্যাত্ব, এটা বুঝতে পারা ইল্কানার জন্য কৃতিত্বের বিষয় ছিল। আর নিশ্চিতভাবেই হান্না প্রেম সম্বন্ধীয় ইল্কানার সদয় আশ্বাসকে মূল্যবান বলে গণ্য করেছিলেন।b কিন্তু ইল্কানা পনিন্নার বিদ্বেষের বিষয়ে উল্লেখ করেননি কিংবা বিবরণও ইঙ্গিত দেয় না যে, হান্না এই সম্বন্ধে তাকে বলেছিলেন। সম্ভবত হান্না দেখেছিলেন যে, পনিন্নার বিষয়ে প্রকাশ করে দেওয়া তার নিজের পরিস্থিতিকে কেবল আরও খারাপই করে তুলত। ইল্কানা কি প্রকৃতপক্ষে বিষয়গুলোকে পরিবর্তন করতে পারতেন? হান্নার প্রতি পনিন্নার বিদ্বেষ কি কেবল বৃদ্ধিই পেত না আর সেই বিদ্বেষী মহিলার সন্তান ও দাস-দাসীরাও কি হান্নাকে ঘৃণা করত না? তার নিজ পরিবারে হান্না কেবল আরও বেশি করে পরিত্যক্ত বলেই বোধ করতেন।
পনিন্নার হীন কাজ সম্বন্ধে ইল্কানা পুরোপুরি জেনে থাকুন অথবা না-ই জেনে থাকুন, যিহোবা ঈশ্বর কিন্তু এর সমস্তকিছুই দেখেছিলেন। তাঁর বাক্য পুরো চিত্রকে প্রকাশ করে আর এভাবে, আপাতদৃষ্টিতে সামান্য ঈর্ষা ও ঘৃণাপূর্ণ কাজে রত এমন যেকারোর প্রতি এক গুরুগম্ভীর সতর্কবাণী প্রদান করে। অন্যদিকে, হান্নার মতো নির্দোষ ও শান্তিপ্রবণ ব্যক্তিরা এটা জেনে সান্ত্বনা লাভ করতে পারে যে, ন্যায়বিচারের ঈশ্বর তাঁর নিজ সময়ে ও নিজ উপায়ে সমস্ত বিষয়কে সংশোধন করেন। (দ্বিতীয় বিবরণ ৩২:৪) সম্ভবত হান্নাও তা জানতেন, কারণ তিনি যিহোবার কাছেই সাহায্য চেয়েছিলেন।
“আর বিষণ্ণ রহিল না”
ভোরবেলায় পরিবার কাজকর্মে ব্যস্ত ছিল। প্রত্যেকে, এমনকী সন্তানেরাও যাত্রার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। শীলোর উদ্দেশে যাত্রার করার জন্য এই বৃহৎ পরিবারকে, পাহাড়ি দেশ ইফ্রয়িমের মধ্যে দিয়ে ৩০ কিলোমিটারেরও বেশি পথ অতিক্রম করতে হতো।c পায়ে হেঁটে যাত্রায়, তা এক অথবা দু-দিন লেগে যেত। হান্না জানতেন যে, তার সপত্নী বা সতীন কেমন আচরণ করবেন। কিন্তু, হান্না বাড়িতে থেকে যাননি। তাই, তিনি আজকের দিনের ঈশ্বরের উপাসকদের জন্য এক অসাধারণ উদাহরণ স্থাপন করেছেন। অন্যদের খারাপ আচরণকে আমাদের ঈশ্বরের উপাসনার ক্ষেত্রে বাধা হতে দেওয়া কখনোই বিজ্ঞতার কাজ নয়। তা করলে, আমরা সেই আশীর্বাদগুলো থেকে বঞ্চিত হব যেগুলো আমাদেরকে সহ্য করার জন্য শক্তি জোগায়।
পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রাস্তায় দীর্ঘ একদিনের পর, সেই বৃহৎ পরিবার অবশেষে শীলোর কাছাকাছি পৌঁছেছিল। উচ্চ পাহাড়গুলোর দ্বারা প্রায় পরিবেষ্টিত একটা পাহাড়ের ওপর এটা অবস্থিত ছিল। তারা যখন কাছাকাছি এসেছিল, তখন হান্না খুব সম্ভবত যিহোবার কাছে প্রার্থনায় তিনি কী বলবেন, সেই সম্বন্ধে অনেক কিছু চিন্তা করেছিলেন। সেখানে পৌঁছানোর পরই, পরিবারটা খাওয়াদাওয়া করেছিল। হান্না সঙ্গেসঙ্গে দল ছেড়ে যিহোবার আবাসের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন। মহাযাজক এলি মন্দিরের দরজার কাছাকাছি বসে ছিলেন। কিন্তু হান্না তার ঈশ্বরের ওপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছিলেন। আবাসে তিনি আস্থা বোধ করেছিলেন যে, তার প্রার্থনা শোনা হবে। যদি কেউ তার দুঃখজনক পরিস্থিতিকে পুরোপুরিভাবে বুঝতে না-ও পারে, স্বর্গে তার পিতা তা পারবেন। তার মনে যে-দুঃখ ছিল, তা প্রকাশ পেয়েছিল আর তিনি কাঁদতে শুরু করেছিলেন।
কান্নার দরুন তার পুরো শরীর যখন কাঁপতে শুরু করেছিল, তখন হান্না অন্তরে যিহোবার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তার যন্ত্রণাকে প্রকাশ করার জন্য মনে মনে কথাগুলোকে গোছানোর সময়ে তার ঠোঁট কাঁপতে শুরু করেছিল। আর তার পিতার কাছে তার হৃদয় উজাড় করে তিনি লম্বা প্রার্থনা করেছিলেন। কিন্তু, সন্তান ধারণের জন্য ঈশ্বরকে তার আকুল আকাঙ্ক্ষাকে পূর্ণ করতে বলার চেয়ে তিনি আরও কিছু করেছিলেন। হান্না ঈশ্বরের কাছ থেকে কেবল আশীর্বাদগুলো লাভ করতেই চাননি কিন্তু সেইসঙ্গে তিনি তাঁকে যা দিতে পারতেন, তা দিতেও চেয়েছিলেন। তাই তিনি এই বলে একটা মানত করেছিলেন যে, তার যদি এক পুত্রসন্তান হয়, তাহলে তিনি সেই সন্তানকে যিহোবাকে সেবা করার জন্য উৎসর্গ করবেন।—১ শমূয়েল ১:৯-১১.
এভাবে প্রার্থনার বিষয়ে ঈশ্বরের সমস্ত দাসের জন্য হান্না এক উদাহরণ স্থাপন করেছেন। এক নির্ভরশীল সন্তান যেমন একজন প্রেমময় বাবা বা মায়ের কাছে বলবে, সেইভাবে কোনোরকম ইতস্তত বোধ না করে তাঁর সঙ্গে খোলাখুলিভাবে কথা বলার ও তাঁর সামনে তাদের উদ্বেগগুলোকে খুলে বলার জন্য যিহোবা সদয়ভাবে তাঁর লোকেদেরকে আমন্ত্রণ জানান। (গীতসংহিতা ৬২:৮; ১ থিষলনীকীয় ৫:১৭) যিহোবার কাছে প্রার্থনা সম্বন্ধে প্রেরিত পিতর এই সান্ত্বনাদায়ক কথাগুলো লিখতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন: “তোমাদের সমস্ত ভাবনার ভার তাঁহার উপরে ফেলিয়া দেও; কেননা তিনি তোমাদের জন্য চিন্তা করেন।”—১ পিতর ৫:৭.
কিন্তু, যিহোবা যতখানি বোঝেন ও সহমর্মিতা দেখান, মানুষেরা ততখানি পারে না। হান্না যখন কাঁদছিলেন ও প্রার্থনা করছিলেন, তখন তিনি একটা কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠেছিলেন। মহাযাজক এলি তাকে লক্ষ্য করছিলেন। তিনি বলেছিলেন: “তুমি কতক্ষণ মত্ত হইয়া থাকিবে? তোমার দ্রাক্ষারস তোমা হইতে দূর কর।” এলি হান্নার কাঁপতে থাকা ঠোঁট, তার কান্না এবং তার আবেগগত আচরণ লক্ষ্য করেছিলেন। সমস্যাটি কী, সেই সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করার পরিবর্তে, তিনি সঙ্গেসঙ্গে এই উপসংহারে পৌঁছেছিলেন যে, হান্না মত্তা ছিলেন।—১ শমূয়েল ১:১২-১৪.
নিদারুণ যন্ত্রণার সেই মুহূর্তে, এই ধরনের এক ভিত্তিহীন অভিযোগ আর সেটা এমন একজন ব্যক্তির কাছ থেকে যিনি সম্মাননীয় এক পদে ছিলেন, সেটার মুখোমুখি হওয়া হান্নার জন্য কতই না আঘাতজনক! তা সত্ত্বেও, তিনি আবারও বিশ্বাসের এক অসাধারণ উদাহরণ স্থাপন করেছিলেন। তিনি মানুষের অসিদ্ধতাগুলোকে, তার যিহোবাকে উপাসনা করার পথে বাধা হতে দেননি। তিনি সম্মানের সঙ্গে এলিকে উত্তর দিয়েছিলেন ও তার পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করেছিলেন। সম্ভবত নিজেকে শুধরে নিয়ে কোমল স্বরে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন: “তুমি শান্তিতে যাও; ইস্রায়েলের ঈশ্বরের কাছে যাহা যাচ্ঞা করিলে, তাহা তিনি তোমাকে দিউন।”—১ শমূয়েল ১:১৫-১৭.
যিহোবার কাছে হৃদয় উজাড় করে দেওয়া ও তাঁর আবাসে তাঁর উপাসনা করা, হান্নার ওপর কী প্রভাব ফেলেছিল? বিবরণ জানায়: “সেই স্ত্রী আপন পথে চলিয়া গেলেন, এবং ভোজন করিলেন; তাঁহার মুখ আর বিষণ্ণ রহিল না।” (১ শমূয়েল ১:১৮) হান্না স্বস্তি অনুভব করেছিলেন। এক অর্থে, তিনি যেন তার আবেগগত বোঝার ভারকে তার নিজের কাঁধের চেয়ে অনেক গুণ প্রশস্ত ও দৃঢ় একজনের, অর্থাৎ তাঁর স্বর্গীয় পিতার কাঁধে ফেলে দিয়েছিলেন। (গীতসংহিতা ৫৫:২২) যে-কোনো সমস্যা কি তাঁর কাছে খুবই ভারি? না—তখনও ছিল না, এখনও নয় আর কখনোই নয়!
আমরা যখন দুঃখের কারণে ভারগ্রস্ত, জর্জরিত হই অথবা ভেঙে পড়ি, তখন আমাদের হান্নার উদাহরণ অনুসরণ করা এবং বাইবেল যাঁকে “প্রার্থনা-শ্রবণকারী” বলে সম্বোধন করে, তাঁর কাছে খোলাখুলিভাবে কথা বলা উচিত। (গীতসংহিতা ৬৫:২) আমরা যদি বিশ্বাস নিয়ে তা করি, তাহলে আমরাও হয়তো দেখব যে, আমাদের দুঃখের জায়গায়, “সমস্ত চিন্তার অতীত যে ঈশ্বরের শান্তি,” তা এসেছে।—ফিলিপীয় ৪:৬, ৭.
“আমাদের ঈশ্বরের তুল্য শৈল নাই”
পরের দিন সকালে, হান্না ইল্কানার সঙ্গে আবাসে ফিরে এসেছিলেন। খুব সম্ভবত তিনি ইল্কানাকে তার অনুরোধ ও তার মানত সম্বন্ধে বলেছিলেন, কারণ মোশির ব্যবস্থায় বলা হয়েছিল যে, স্বামীর অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রীর করা কোনো মানতকে বাতিল করার অধিকার তার ছিল। (গণনাপুস্তক ৩০:১০-১৫) কিন্তু সেই বিশ্বস্ত ব্যক্তি তার মানতকে বাতিল করেননি। এর পরিবর্তে, বাড়ি ফেরার আগে তিনি এবং হান্না একসঙ্গে আবাসে যিহোবার উপাসনা করেছিলেন।
পনিন্না ঠিক কখন বুঝতে পেরেছিলেন যে, হান্নাকে হতাশ করার ব্যাপারে তিনি তার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন? বিবরণ তা বলে না কিন্তু “আর বিষণ্ণ রহিল না” অভিব্যক্তিটি ইঙ্গিত দেয় যে, হান্না খুশি ছিলেন এবং আর বিষণ্ণ ছিলেন না। যা-ই হোক না কেন, পনিন্না শীঘ্র বুঝতে পেরেছিলেন যে, তার বিদ্বেষপূর্ণ আচরণের কোনো ফলই হয়নি। বাইবেলে আর কখনোই তার নাম পুনরায় উল্লেখ করা হয়নি।
মাসগুলো পেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, হান্নার মনের শান্তি পরম সুখে পরিণত হয়েছিল। তিনি গর্ভবতী হয়েছিলেন! আনন্দের মধ্যে, হান্না কখনো এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে যাননি যে, এই আশীর্বাদ কোথা থেকে এসেছিল। বালকটি যখন জন্মেছিলেন, তখন হান্না তার নাম রেখেছিলেন শমূয়েল, যার অর্থ “ঈশ্বরের নাম” আর স্পষ্টতই তা ঐশিক নামে সম্বোধন করাকে নির্দেশ করে, যেমনটা হান্না করেছিলেন। সেই বছর, তিনি শীলোতে যাত্রা করার জন্য ইল্কানা ও তার পরিবারের সঙ্গে যোগ দেননি। সেই শিশুটি স্তন্যপান ত্যাগ না করা পর্যন্ত, তিনি তার সঙ্গে তিন বছর বাড়িতেই থেকে গিয়েছিলেন। এরপর তিনি সেই দিনের জন্য শক্তি সঞ্চয় করেছিলেন যেদিনে তাকে তার প্রিয় পুত্রসন্তানকে ত্যাগ করতে হবে।
বিদায় জানানোটা হয়তো সহজ ছিল না। অবশ্য হান্না জানতেন যে, শীলোতে ভালোভাবে শমূয়েলের যত্ন নেওয়া হবে, সম্ভবত এমন কিছু স্ত্রীলোকের তত্ত্বাবধানে যারা আবাসে সেবা করত। তবুও, তিনি খুবই ছোটো ছিলেন আর কোন মা-ই বা এই সময়ে তার সন্তানের সঙ্গে থাকার আকুল আকাঙ্ক্ষা করে না? তা সত্ত্বেও, হান্না ও ইল্কানা অনিচ্ছুকভাবে নয়, বরং কৃতজ্ঞতা সহকারে ছেলেটিকে নিয়ে এসেছিলেন। তারা ঈশ্বরের গৃহে বলি উৎসর্গ করেছিল আর তারা কয়েক বছর আগে হান্নার করা মানতের কথা এলিকে মনে করিয়ে দিয়ে তার কাছে শমূয়েলকে উপস্থিত করেছিল।
এরপর হান্না এমন এক প্রার্থনা করেছিলেন, যেটাকে ঈশ্বর তাঁর অনুপ্রাণিত বাক্যে অন্তর্ভুক্ত করার উপযুক্ত বলে মনে করেছিলেন। আপনি যখন ১ শমূয়েল ২:১-১০ পদে লিপিবদ্ধ তার কথাগুলো পড়বেন, তখন আপনি প্রতিটা লাইনে প্রকাশিত তার গভীর বিশ্বাসকে দেখতে পাবেন। তাঁর শক্তির চমৎকার ব্যবহারের—অহংকারীকে অবনত করার, নিপীড়িতকে আশীর্বাদ করার এবং জীবনকে শেষ করা অথবা এমনকী মৃত্যু থেকে সেটাকে রক্ষা করার অতুলনীয় ক্ষমতার—জন্য তিনি যিহোবার প্রশংসা করেছিলেন। তাঁর পিতার অদ্বিতীয় পবিত্রতা, তাঁর ন্যায়বিচার ও তাঁর বিশ্বস্ততার জন্য তিনি তাঁর প্রশংসা করেছিলেন। তাই উত্তম কারণে হান্না বলতে পেরেছিলেন: “আমাদের ঈশ্বরের তুল্য শৈল নাই।” যিহোবা পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল, অপরিবর্তনীয় আর নিপীড়িত ও দুর্দশাগ্রস্ত সেই সকলের জন্য এক আশ্রয়, যারা সাহায্যের জন্য তাঁর ওপর নির্ভর করে।
নিশ্চিতভাবে ছোট্ট শমূয়েল এমন একজন মা পেয়ে বিশেষ সুযোগপ্রাপ্ত ছিলেন, যার যিহোবার প্রতি প্রচুর বিশ্বাস ছিল। যদিও বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, নিঃসন্দেহে তিনি তার মায়ের অভাব বোধ করতেন কিন্তু তিনি কখনো মনে করেননি যে, তাকে ভুলে যাওয়া হয়েছে। প্রতি বছর, হান্না শীলোতে ফিরে যেতেন ও আবাসে শমূয়েলের সেবার জন্য একটা ছোটো হাতকাটা জামা নিয়ে আসতেন। সেই জামার প্রতিটা সেলাই, তার ছেলের জন্য তার ভালোবাসা ও যত্নের প্রমাণ দিত। (১ শমূয়েল ২:১৯) আমরা কেবল কল্পনা করতে পারি যে, তিনি ছেলেকে সেই নতুন জামাটা পরিয়ে দিচ্ছেন, সেটাকে টেনে সোজা করে দিচ্ছেন এবং সদয় ও উৎসাহজনক কথাগুলো বলার সময় স্নেহের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। এইরকম একজন মাকে পেয়ে শমূয়েল আশীর্বাদপ্রাপ্ত হয়েছিলেন আর তিনি তার বাবা-মা ও সমস্ত ইস্রায়েলের জন্য এক আশীর্বাদ হিসেবে বড়ো হয়ে উঠেছিলেন।
আর হান্নার বিষয়টাও ভুলে যাওয়া হয়নি। সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা দিয়ে যিহোবা তাকে আশীর্বাদ করেছিলেন আর তিনি ইল্কানার জন্য আরও পাঁচটা সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। (১ শমূয়েল ২:২১) কিন্তু, সম্ভবত হান্নার সবচেয়ে বড়ো আশীর্বাদটা ছিল তার সঙ্গে তার পিতা যিহোবার বন্ধন, যা বছরের পর বছর ধরে আরও শক্তিশালী হয়েছিল। হান্নার বিশ্বাসকে অনুকরণ করার সময় আপনার ক্ষেত্রেও যেন তা সত্য হয়। (w১০-E ০৭/০১)
[পাদটীকাগুলো]
a কেন ঈশ্বর তাঁর লোকেদের মাঝে কিছু সময়ের জন্য বহুগামিতাকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন, সেই বিষয়ে ২০০৩ সালের ১ আগস্ট প্রহরীদুর্গ পত্রিকার ২৮ পৃষ্ঠায় “পাঠক-পাঠিকাদের থেকে প্রশ্নসকল” শিরোনামের প্রবন্ধটি দেখুন।
b যদিও বিবরণ জানায় যে, যিহোবা “হান্নার গর্ব্ভ রুদ্ধ করিয়াছিলেন,” কিন্তু ঈশ্বর এই নম্র ও বিশ্বস্ত মহিলার প্রতি অখুশি ছিলেন, এমন কোনো প্রমাণ নেই। (১ শমূয়েল ১:৫) কখনো কখনো বাইবেল সেই ঘটনাগুলোকে ঈশ্বর ঘটিয়েছেন বলে নির্দেশ করে, যেগুলোকে তিনি কেবল কিছু সময়ের জন্য ঘটার অনুমতি দিয়েছিলেন।
c দূরত্বটা এই সম্ভাবনার ওপর ভিত্তি করে যে, ইল্কানার নিজ নগর রামা ছিল সেই একই জায়গা, যেটা যিশুর দিনে অরিমাথিয়া হিসেবে পরিচিত হয়েছিল।
[২৭ পৃষ্ঠার বাক্স]
দুটো উল্লেখযোগ্য প্রার্থনা
প্রথম শমূয়েল ১:১১ ও ২:১-১০ পদে লিপিবদ্ধ হান্নার প্রার্থনা দুটোতে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য দিক রয়েছে। এর মাত্র কয়েকটা বিবেচনা করুন:
◼ হান্না দুটো প্রার্থনার প্রথমটা “বাহিনীগণের সদাপ্রভু”-র উদ্দেশে করেছিলেন। বাইবেলের বিবরণে তিনিই হলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি এই উপাধিটি ব্যবহার করেছিলেন বলে উদ্ধৃতি করা হয়েছে। বাইবেলের মূল লেখাগুলোতে এটি মোট ২৮৫ বার পাওয়া যায় আর তা এক বিরাট সংখ্যার আত্মিক পুত্রদের ওপর ঈশ্বরের কর্তৃত্বকে নির্দেশ করে।
◼ লক্ষ করুন যে, হান্না তার ছেলের জন্মের সময়ে নয় কিন্তু যখন তিনি ও ইল্কানা শীলোতে ঈশ্বরের সেবার জন্য তাকে উৎসর্গ করেছিলেন, তখন দ্বিতীয় প্রার্থনাটি করেছিলেন। তাই, হান্না তার সতীন পনিন্নাকে চুপ করিয়ে দেওয়ার জন্য নয়, বরং যিহোবার দ্বারা আশীর্বাদপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে আনন্দিত হয়েছিলেন।
◼ হান্না যখন বলেছিলেন যে, “আমার শৃঙ্গ সদাপ্রভুতে উন্নত হইল,” তখন তার মনে হয়তো মালবাহী এক শক্তিশালী পশু, ষাঁড়ের বিষয়টা ছিল, যে তার শিংগুলোকে শক্তির সঙ্গে ব্যবহার করে। বস্তুতপক্ষে, হান্না বলছিলেন: ‘যিহোবা, তুমি আমাকে শক্তিশালী করো।’—১ শমূয়েল ২:১.
◼ ঈশ্বরের “অভিষিক্ত ব্যক্তির” বিষয়ে হান্নার কথাগুলোকে ভবিষ্যদ্বাণীমূলক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই অভিব্যক্তিটি “মশীহ” হিসেবেও অনুবাদিত হয়েছে আর বাইবেলের বিবরণে হান্নাই হলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি একজন ভাবী অভিষিক্ত রাজাকে নির্দেশ করার জন্য এটি ব্যবহার করেছেন।—১ শমূয়েল ২:১০.
◼ প্রায় ১,০০০ বছর পরে যিশুর মা মরিয়ম, যিহোবার প্রশংসা করার সময় হান্নার অভিব্যক্তিগুলোর কয়েকটা তার নিজের ভাষায় পুনরাবৃত্তি করেছিলেন।—লূক ১:৪৬-৫৫.
[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]
হান্না তার বন্ধ্যাত্বের কারণে খুবই দুঃখিত ছিলেন আর পনিন্না হান্নাকে আরও খারাপ অনুভব করানোর জন্য তার যথাসাধ্য করেছিলেন
[২৬, ২৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
যদিও এলি ভুলভাবে তার বিচার করেছিলেন, তবুও হান্না অসন্তুষ্ট হননি
[২৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
আপনি কি অন্তর থেকে প্রার্থনা করার বিষয়ে হান্নার উদাহরণকে অনুকরণ করতে পারেন?