বিভক্ত এক জগতে খ্রীষ্টীয় অতিথি-সেবা
“অতএব আমরা এই প্রকার লোকদিগকে সাদরে গ্রহণ করিতে বাধ্য, যেন সত্যের সহকারী হইতে পারি।”—৩ যোহন ৮.
১. সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত কোন্ উপহারগুলি সৃষ্টকর্তা মানবজাতিকে দিয়েছেন?
“ভোজন পান ও আমোদ করণ ব্যতীত সূর্য্যের নীচে মানুষের আর ভাল কিছু নাই; সূর্য্যের নীচে ঈশ্বরদত্ত তাহার জীবনকালে উহাই তাহার পরিশ্রমে তাহার সহবর্ত্তী হইবে।” (উপদেশক ৮:১৫) ঐ বাক্যগুলির দ্বারা প্রাচীন ইব্রীয় উপদেশক আমাদের বলেন যে, যিহোবা ঈশ্বর চান না তাঁর সৃষ্ট মানুষেরা শুধু আনন্দিত এবং সুখীই হোক, কিন্তু তা হওয়ার জন্য তিনি মাধ্যমগুলিও সরবরাহ করে থাকেন। মানবজাতির সমগ্র ইতিহাসব্যাপী সর্বদাই লোকেদের মধ্যে একটি সাধারণ আকাঙ্ক্ষা দেখা যায় যে তারা নিজেদেরকে আনন্দিত করতে এবং এক উত্তম সময় অতিবাহিত করতে চায়।
২. (ক) যিহোবা তাদের জন্য যা উদ্দেশ্য করেছিলেন মানবজাতি কিভাবে তার অপব্যবহার করেছে? (খ) এর ফল কী হয়েছে?
২ বর্তমানে আমরা এমন এক আনন্দবাদী সমাজে বাস করছি যেখানে লোকেরা আনন্দ এবং উত্তম সময় লাভের চেষ্টায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। অধিকাংশ লোকেরা বাইবেল যেমন ভাববাণী করেছিল তেমনি “আত্মপ্রিয়, . . . ঈশ্বরপ্রিয় নয়, বরং বিলাসপ্রিয়।” (২ তীমথিয় ৩:১-৪) এটি অবশ্যই যিহোবা ঈশ্বর যা উদ্দেশ্য করেছিলেন সে ক্ষেত্রে এক প্রচণ্ড বিকৃতি। যখন এক উত্তম সময় লাভ করাই প্রধান লক্ষ্য হয় অথবা যখন আত্ম-সন্তুষ্টি একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়, তখন প্রকৃত পরিতৃপ্তি পাওয়া যায় না এবং “সকলই অসার ও বায়ুভক্ষণ মাত্র” হয়। (উপদেশক ১:১৪; ২:১১) ফলস্বরূপ, জগৎ নিঃসঙ্গ এবং হতাশাগ্রস্ত লোকেদের দ্বারা পরিপূর্ণ, যেটি পরিশেষে সমাজের অনেক সমস্যার দিকে পরিচালিত করে। (হিতোপদেশ ১৮:১) লোকেরা একে অপরের প্রতি সন্দেহপ্রবণ এবং জাতিগত, উপজাতিগত, সমাজগত ও অর্থনীতিগতভাবে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
৩. কিভাবে আমরা প্রকৃত আনন্দ এবং পরিতৃপ্তি খুঁজে পেতে পারি?
৩ দয়ালু, উদার, অতিথিপরায়ণ হয়ে—অপরের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে যদি লোকেরা যিহোবার পথকে অনুকরণ করত তাহলে এটি কতই না ভিন্ন হত! তিনি এটি পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন যে প্রকৃতপক্ষে সুখী হওয়ার রহস্যটি আমাদের নিজেদের আকাঙ্ক্ষাগুলিকে পূর্ণ করার জন্য আমাদের যে চেষ্টা তার মধ্যে শায়িত নেই। বরঞ্চ, চাবিটি হচ্ছে: “গ্রহণ করা অপেক্ষা বরং দান করা ধন্য হইবার বিষয়।” (প্রেরিত ২০:৩৫) প্রকৃত আনন্দ এবং পরিতৃপ্তি খুঁজে পাওয়ার জন্য, আমাদের অবশ্যই সেই প্রতিবন্ধকতা এবং বিভাগগুলি যা আমাদের সীমাবদ্ধ করতে পারে তা অতিক্রম করতে হবে। আর আমাদের অবশ্যই আমাদের সাথে যারা যিহোবাকে সেবা করে চলেছেন তাদের কাছে পৌঁছাতে হবে। এই পরামর্শে মনোযোগ করা তাই আমাদের জন্য অত্যাবশ্যক: “অতএব আমরা এই প্রকার লোকদিগকে সাদরে গ্রহণ করিতে বাধ্য, যেন সত্যের সহকারী হইতে পারি।” (৩ যোহন ৮) আমাদের পরিস্থিতি যতখানি অনুমতি দেয় ততখানি প্রসারিতভাবে যোগ্য ব্যক্তিদের প্রতি অতিথি-সেবা প্রদর্শন দুটি উপায়ে লাভজনক—এটি দাতা এবং গ্রহীতা উভয়কেই উপকৃত করে। তাহলে, কারা এই যোগ্য ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত যাদেরকে আমরা ‘সাদরে গ্রহণ’ করব?
‘পিতৃমাতৃহীনদের ও বিধবাদের তত্ত্বাবধান কর’
৪. এমনকি কিছু যিহোবার লোকেদের মধ্যেও পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোন্ পরিবর্তন দেখা যায়?
৪ বর্তমানে স্থায়ী পরিবার এবং সুখী বিবাহ খুবই বিরল। পৃথিবীর চারিদিকে ক্রমবর্ধমান বিবাহ-বিচ্ছেদের হার এবং অবিবাহিত মায়েদের সংখ্যা অত্যন্ত চরমভাবে পরম্পরাগত পরিবার ব্যবস্থাকে বদলে ফেলেছে। ফলস্বরূপ, সাম্প্রতিক কালে যারা যিহোবার সাক্ষী হয়েছে তাদের অনেকেই ভগ্ন পরিবার থেকে এসেছে। হয় তারা বিবাহ বিচ্ছেদপ্রাপ্ত অথবা তাদের বিবাহিত সাথীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন কিংবা তারা একক অভিভাবক বিশিষ্ট পরিবারগুলিতে বাস করে। এছাড়া, যেমন যীশু ভাববাণী করেছিলেন, যে সত্য তিনি শিখিয়েছিলেন তা অনেক পরিবারকে বিভক্ত করার কারণস্বরূপ হয়েছে।—মথি ১০:৩৪-৩৭; লূক ১২:৫১-৫৩.
৫. যীশু কী বলেছিলেন যা যারা বিভক্ত পরিবারে রয়েছে তাদের জন্য উৎসাহের উৎস হতে পারে?
৫ নতুনেরা সত্যের পক্ষে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করছে এটা দেখা আমাদের হৃদয়কে উষ্ণ করে তোলে আর আমরা প্রায়ই তাদের যীশুর এই উৎসাহমূলক প্রতিজ্ঞাটির দ্বারা সান্ত্বনা দিয়ে থাকি: “আমি তোমাদিগকে সত্য কহিতেছি, এমন কেহ নাই, যে আমার নিমিত্ত ও সুসমাচারের নিমিত্ত বাটী কি ভ্রাতৃগণ কি ভগিনী কি মাতা কি পিতা কি সন্তানসন্ততি কি ক্ষেত্র ত্যাগ করিয়াছে, কিন্তু এখন ইহকালে তাহার শতগুণ না পাইবে; সে বাটী, ভ্রাতা, ভগিনী, মাতা, সন্তান ও ক্ষেত্র, তাড়নার সহিত এই সকল পাইবে, এবং আগামী যুগে অনন্ত জীবন পাইবে।”—মার্ক ১০:২৯, ৩০.
৬. আমাদের মাঝে যে “পিতৃমাতৃহীন ও বিধবা” রয়েছেন, আমরা কিভাবে তাদের ‘ভাইবোন, মা এবং সন্তানসন্ততি’ হতে পারি?
৬ তাহলে, এই ‘ভাইবোন, মা এবং সন্তানসন্ততিরা’ কারা? শুধুমাত্র কিংডম হলে এক বৃহৎ সংখ্যক লোকেদের, প্রায়ই একশত বা তারও বেশি সংখ্যক ব্যক্তি যারা নিজেদেরকে ভাইবোন হিসাবে সম্বোধন করে তাদের দেখা স্বাভাবিকভাবেই একজন ব্যক্তিকে তার ভাই, বোন, মা এবং সন্তান হিসাবে মনে করতে প্রবৃত্ত করে না। এই বিষয়টি বিবেচনা করুন: শিষ্য যাকোব আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে আমাদের উপাসনা ঈশ্বরের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য আমাদের অবশ্যই ‘ক্লেশাপন্ন পিতৃমাতৃহীনদের ও বিধবাদের তত্ত্বাবধান করতে এবং সংসার থেকে নিজেদেরকে নিষ্কলঙ্করূপে রক্ষা করতে হবে।’ (যাকোব ১:২৭) এর অর্থ হচ্ছে যে, আমরা অবশ্যই “পিতৃমাতৃহীন ও বিধবাদের” প্রতি আমাদের করুণার দরজা বন্ধ করতে অর্থপ্রাচুর্যতার অহংকার এবং সামাজিক অবস্থান সম্বন্ধীয় জাগতিক মনোভাবকে অনুমতি দেব না। পরিবর্তে, তাদের প্রতি আমাদের সহভাগিতা এবং অতিথি-সেবা প্রসারিত করতে আমরা অবশ্যই প্রথম উদ্যোগ নেব।
৭. (ক) “পিতৃমাতৃহীন ও বিধবাদের” প্রতি অতিথিপরায়ণ হওয়ার আসল উদ্দেশ্য কী? (খ) আর কারা খ্রীষ্টীয় অতিথি-সেবা প্রদর্শনে অংশগ্রহণ করতে পারে?
৭ “পিতৃমাতৃহীন ও বিধবাদের” প্রতি অতিথি-সেবা প্রদর্শন করা বস্তুগতভাবে তাদের যে অভাব হতে পারে, সর্বদা সেটিকেই অন্তর্ভুক্ত করে না। একক অভিভাবক পরিবার বা ধর্মীয়ভাবে বিভক্ত পরিবারগুলি সবসময় যে অর্থনৈতিকভাবে সমস্যায় থাকে তা নয়। কিন্তু, স্বাস্থ্যকর মেলামেশা, পারিবারিক পরিবেশ, বিভিন্ন বয়সের ব্যক্তিদের প্রতি সহভাগিতা এবং উত্তম আধ্যাত্মিক বিষয়গুলিকে ভাগ করে নেওয়া—এইগুলি হচ্ছে জীবনের কিছু ক্ষেত্র যা সম্পদস্বরূপ। উপলক্ষটিকে জাঁকজমকপূর্ণ করার চেয়ে বরঞ্চ, প্রেম এবং একতার মনোভাব হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ, এটি স্মরণে রেখে তা দেখা কতই না উত্তম যে মাঝে মাঝে, এমনকি ‘পিতৃমাতৃহীন ও বিধবারাও’ সহখ্রীষ্টানদের প্রতি অতিথি-সেবা প্রদর্শনে অংশগ্রহণ করতে পারে!—তুলনা করুন ১ রাজাবলি ১৭:৮-১৬.
আমাদের মধ্যে কি বিদেশীরা আছে?
৮. যিহোবার সাক্ষীদের অনেক মণ্ডলীগুলিতে কোন্ পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে?
৮ আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যখন এক বৃহৎ সংখ্যক লোকেরা ভ্রমণশীল। ওয়ার্ল্ড প্রেস রিভিউ বলে, “পৃথিবীর চতুর্দিকে দশ কোটিরও বেশি লোকেরা এমন দেশগুলিতে বাস করছে যেখানকার নাগরিক তারা নয় এবং দুই কোটি ত্রিশ লক্ষ লোকেরা তাদের নিজেদের দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছে।” অনেক এলাকায় বিশেষত বৃহত্তর শহরগুলিতে এর প্রত্যক্ষ ফলাফল হয়েছে এইরকম যে, যিহোবার লোকেদের মণ্ডলীগুলি যা একসময় প্রধানত একটি জাতি বা জাতীয়তাবাদীর লোকেদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল, কিন্তু এখন পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের লোকেরা এর অন্তর্ভুক্ত। সম্ভবত, আপনি যেখানে বাস করছেন সেখানেও এই বিষয়টি সত্য। তাই, জগৎ যাদেরকে “প্রবাসী” বা “বিদেশী” বলে সম্বোধন করে, যাদের ভাষা, রীতিনীতি এবং জীবন-যাত্রা হয়ত আমাদের থেকে ভিন্ন, তাদেরকে আমাদের কিভাবে দেখা উচিত?
৯. খ্রীষ্টীয় মণ্ডলীতে যে “প্রবাসী” এবং ‘বিদেশীরা’ আসছেন তাদের সম্বন্ধে কোন্ দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের গুরুতর ফাঁদে ফেলতে পারে?
৯ সাধারণভাবে বলতে গেলে, বিদেশীদের প্রতি আমাদের অহেতুক ভয় বা ঘৃণা প্রদর্শনের প্রবণতাকে কখনও অনুমতি দেওয়া উচিত নয় যা আমাদেরকে মনে করাতে পারে, যারা অপরিচিত বা তথাকথিত পৌত্তলিক দেশ থেকে এসেছে তাদের তুলনায় যে কোনভাবে সত্য জানার ক্ষেত্রে সুযোগপ্রাপ্ত হওয়ায় আমরা আরও বেশি যোগ্য; অথবা আমাদের এও মনে করা উচিত নয় যে, এই নবাগতেরা কিংডম হল এবং অন্যান্য সম্পত্তি ব্যবহার করার ফলে সীমা লঙ্ঘন করছে। প্রথম-শতাব্দীর কিছু যিহূদীরা যারা এইধরনের দৃষ্টিভঙ্গিকে পোষণ করত, তাদেরকে প্রেরিত পৌলের এই কথাটি মনে করিয়ে দিতে হয়েছিল যে আসলে যোগ্য কেউই নয় বরঞ্চ, এটি ছিল যিহোবার অযাচিত করুণা যা যে কোন ব্যক্তির পক্ষে পরিত্রাণ অর্জন করা সম্ভবপর করেছে। (রোমীয় ৩:৯-১২, ২৩, ২৪) আমাদের আনন্দিত হওয়া উচিত যে যিহোবার অযাচিত করুণা এখন অনেক ব্যক্তির কাছে পৌঁছাচ্ছে যারা যে কোনভাবেই হোক সুসমাচার শোনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। (১ তীমথিয় ২:৪) আমরা কিভাবে দেখাতে পারি যে তাদের প্রতি আমাদের অনুরাগ অকৃত্রিম?
১০. আমাদের মধ্যে যে ‘বিদেশীরা’ আছেন তাদের প্রতি যে আমরা অকৃত্রিম আতিথ্যপরায়ণ, তা আমরা কিভাবে প্রদর্শন করতে পারি?
১০ আমরা পৌলের উপদেশকে অনুসরণ করতে পারি: “অতএব যেমন খ্রীষ্ট তোমাদিগকে গ্রহণ করিলেন, তেমনি ঈশ্বরের গৌরবের জন্য তোমরা এক জন অন্যকে গ্রহণ কর।” (রোমীয় ১৫:৭) অন্য দেশ বা প্রেক্ষাপট থেকে আসা লোকেরা প্রায়ই কম সুযোগের অধিকারী হয় তা উপলব্ধি করে, আমাদের উচিত তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করা এবং চিন্তা করা যখন তা করার ক্ষমতা আমাদের থাকে। তাদেরকে আমাদের মাঝে আমন্ত্রণ জানানো, তাদের প্রত্যেকের সাথে “তোমাদের স্বদেশীয় লোক যেমন,” তেমন আচরণ এবং “তাকে আপনার মত প্রেম” করা উচিত। (লেবীয় পুস্তক ১৯:৩৪) এটি করা হয়ত সহজ নয়, কিন্তু তবুও আমরা সফল হব যদি আমরা এই পরামর্শ স্মরণে রাখি: “এই যুগের অনুরূপ হইও না, কিন্তু মনের নূতনীকরণ দ্বারা স্বরূপান্তরিত হও; যেন তোমরা পরীক্ষা করিয়া জানিতে পার, ঈশ্বরের ইচ্ছা কি, যাহা উত্তম ও প্রীতিজনক ও সিদ্ধ।”—রোমীয় ১২:২.
পবিত্রগণের সহভাগী হও
১১, ১২. যিহোবার নির্দিষ্ট কিছু দাসেদের প্রতি কোন্ বিশেষ বিবেচনা দেখানো হয়েছিল (ক) প্রাচীন ইস্রায়েলে (খ) প্রথম শতাব্দীতে?
১১ পরিপক্ব খ্রীষ্টানেরা যারা আমাদের আধ্যাত্মিক মঙ্গল সাধনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করে থাকেন, সত্যই তারা আমাদের বিবেচনা এবং অতিথি-সেবা পাওয়ার যোগ্য। প্রাচীন ইস্রায়েলে যিহোবা যাজক এবং লেবীয়দের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করেছিলেন। (গণনাপুস্তক ১৮:২৫-২৯) এছাড়া প্রথম-শতাব্দীতেও খ্রীষ্টানদের তাদের প্রতি যত্ন নিতে উৎসাহিত করা হয়েছিল, যারা বিশেষ দায়িত্ব পালন করতেন। ৩ যোহন ৫-৮ এর বিবরণ আমাদেরকে প্রাথমিক খ্রীষ্টানদের মধ্যে বিদ্যমান প্রেমের নিবিড় বন্ধনের এক আভাস দেয়।
১২ মণ্ডলী পরিদর্শনের জন্য প্রেরিত কিছু ভ্রমণকারী ভাইয়েদের প্রতি গায়ের প্রদর্শিত দয়া এবং অতিথি-সেবাকে বৃদ্ধ প্রেরিত যোহন উচ্চভাবে মূল্যায়ন করেছিলেন। এই ভাইয়েরা—যার অন্তর্ভুক্ত ছিল দীমীত্রিয় মনে হয় পত্রবাহক ছিলেন—যারা সকলেই পূর্বে গায়ের অপরিচিত অথবা অচেনা ছিলেন। কিন্তু, তারা সাদরে গৃহীত হয়েছিলেন কারণ “[ঈশ্বরের] নামের অনুরোধে তাঁহারা বাহির হইয়াছেন।” যোহন এটিকে এইভাবে বলেছিলেন: “অতএব আমরা এই প্রকার লোকদিগকে সাদরে গ্রহণ করিতে বাধ্য, যেন সত্যের সহকারী হইতে পারি।”—৩ যোহন ১, ৭, ৮.
১৩. বর্তমানে আমাদের মধ্যে কারা ‘সাদরে গ্রহণের’ যোগ্য?
১৩ বর্তমানে, যিহোবার সংগঠনে অনেক ব্যক্তিরা আছেন, যারা সমগ্র ভ্রাতৃসমাজের জন্য নিজেদেরকে সক্রিয়ভাবে নিযুক্ত রেখেছেন। এগুলি ভ্রমণ অধ্যক্ষদের, যারা সপ্তাহের পর সপ্তাহ মণ্ডলীগুলিকে গড়ে তোলার জন্য নিজেদের সময় এবং শক্তি ব্যয় করে চলেছেন; মিশনারীদের, যারা বিদেশে প্রচার করার জন্য তাদের পরিবার এবং বন্ধুদের ছেড়ে এসেছেন; বিশ্বব্যাপী প্রচার কাজকে সমর্থন করার জন্য যারা বেথেল গৃহ বা শাখা অফিসগুলিতে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে পরিচর্যা করছেন; এবং অগ্রগামীর কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা, যারা তাদের সময় এবং শক্তির একটি বৃহৎ অংশ ক্ষেত্রের পরিচর্যায় ব্যয় করছেন তাদের সকলকে অন্তর্ভুক্ত করে। এই ব্যক্তিরা, মূলতঃ ব্যক্তিগত গৌরব বা কোন কিছু লাভ করার জন্য নয় বরঞ্চ, খ্রীষ্টীয় ভ্রাতৃসমাজ এবং যিহোবার প্রতি প্রেমের জন্যই কঠোরভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তাদের সম্পূর্ণ-চিত্তে ভক্তির জন্য তারা আমাদের অনুকরণের এবং ‘সাদরে গ্রহণের’ যোগ্য।
১৪. (ক) কিভাবে আমরা আরও উত্তম খ্রীষ্টান হই, যখন আমরা বিশ্বস্ত জনদের প্রতি আতিথি-সেবা প্রদর্শন করি? (খ) কেন যীশু বলেছিলেন যে মরিয়ম “উত্তম অংশটী” মনোনীত করেছেন?
১৪ প্রেরিত যোহন উল্লেখ করেছিলেন, যখন আমরা “এই প্রকার লোকদিগকে সাদরে গ্রহণ” করি, “আমরা সত্যের সহকারী” হই। ফলস্বরূপ, এক অর্থে আমরা আরও উত্তম খ্রীষ্টান হই। কারণ খ্রীষ্টীয় কাজ সহবিশ্বাসীদের প্রতি উত্তম কাজ করাকে অন্তর্ভুক্ত করে। (হিতোপদেশ ৩:২৭, ২৮; ১ যোহন ৩:১৮) অন্য দিক দিয়েও এর পুরস্কার আছে। যখন মরিয়ম এবং মার্থা তাদের গৃহে যীশুর আতিথ্য করেছিলেন, মার্থা যীশুর জন্য “অনেক বিষয়” প্রস্তুত করার দ্বারা একজন উত্তম অতিথিসেবিকা হতে চেয়েছিলেন। মরিয়ম এক ভিন্ন উপায়ে অতিথি-সেবা প্রদর্শন করেছিলেন। তিনি “প্রভুর চরণের নিকটে বসিয়া তাঁহার বাক্য শুনিতে লাগিলেন,” এবং যীশু তাকে “উত্তম অংশটী” মনোনীত করার জন্য প্রশংসা করেছিলেন। (লূক ১০:৩৮-৪২) বহু বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সাথে কথোপকথন এবং আলোচনা করা প্রায়ই তাদের সাথে কাটানো এক সন্ধ্যার সবচেয়ে সুন্দর সময় হতে পারে।—রোমীয় ১:১১, ১২.
বিশেষ উপলক্ষগুলিতে
১৫. কোন্ বিশেষ উপলক্ষগুলি যিহোবার লোকেদের জন্য হয়ত আনন্দের সময় হিসাবে প্রমাণিত হতে পারে?
১৫ যদিও সত্য খ্রীষ্টানেরা কোন জনপ্রিয় রীতিনীতি পালন বা জাগতিক ছুটি এবং উৎসবগুলি উদ্যাপন করে না, তবুও কিছু উপলক্ষ রয়েছে যখন তারা একে অপরের সাহচর্য উপভোগ করার জন্য একত্রে মিলিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, যীশু কান্না নগরের এক বিবাহ ভোজে যোগ দিয়েছিলেন এবং সেখানে তাঁর প্রথম অলৌকিক কাজ সম্পাদন করার দ্বারা সেই উপলক্ষের আনন্দকে বাড়িয়ে তুলেছিলেন। (যোহন ২:১-১১) অনুরূপভাবে বর্তমানে, যিহোবার লোকেদের জন্যও একইরূপ বিশেষ উপলক্ষগুলিতে একত্রে আনন্দিত হওয়ার সময় আসে এবং যথার্থ উদ্যাপন ও উৎসবগুলি সেই ধরনের ঘটনাগুলিতে অনেক কিছু যুক্ত করে। তাহলে, যথার্থ কী?
১৬. যথার্থ আচরণ প্রদর্শনের জন্য, এমনকি বিশেষ উপলক্ষগুলিতেও কোন্ নির্দেশাবলী আমাদের রয়েছে?
১৬ আমাদের বাইবেল অধ্যয়ন থেকে আমরা জানি খ্রীষ্টানদের জন্য যথার্থ আচরণ কী এবং আমরা সর্বদা তা অনুসরণ করি। (রোমীয় ১৩:১২-১৪; গালাতীয় ৫:১৯-২১; ইফিষীয় ৫:৩-৫) সামাজিক মেলামেশাগুলি তা সে বিবাহ সংক্রান্ত বা অন্য যে কোন কারণের সাথে সম্পর্কযুক্ত হোক, আমাদের খ্রীষ্টীয় মানকে পরিত্যাগ অথবা এমন কিছু করার, যা আমরা সচরাচর করি না, স্বাধীনতা প্রদান করে না; অথবা যে দেশে আমরা বাস করি সেখানকার সমস্ত রীতিনীতি অনুসরণ করতে আমরা বাধ্য নই। এই বিষয়গুলির অধিকাংশই মিথ্যা ধর্মীয় অভ্যাস বা কুসংস্কারের উপর প্রতিষ্ঠিত; আর অন্যান্যগুলি এমন আচরণকে জড়িত করে যা স্পষ্টভাবে খ্রীষ্টানদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।—১ পিতর ৪:৩, ৪.
১৭. (ক) কোন্ বিষয়গুলি দেখায় যে কান্না নগরের বিবাহ ভোজ সুসংগঠিত ছিল এবং যথার্থভাবে তত্ত্বাবধান করা হয়েছিল? (খ) কী ইঙ্গিত করে যে যীশু সেই উপলক্ষকে অনুমোদন করেছিলেন?
১৭ যোহন ২:১-১১ পদ পড়ে, আমাদের জন্য এটি দেখা কষ্টকর নয় যে সেটি এক জাঁকজমকপূর্ণ উপলক্ষ ছিল এবং সেখানে এক বৃহৎ সংখ্যক অতিথি উপস্থিত ছিলেন। যীশু ও তাঁর শিষ্যেরা সেখানে ‘নিমন্ত্রিত’ অতিথি ছিলেন; তারা কেবলমাত্র অপ্রত্যাশিত পরিদর্শক ছিলেন না, এমনকি তাদের মধ্যে কেউ কেউ সম্ভবত গৃহকর্তার আত্মীয়ও ছিলেন। আমরা এও লক্ষ্য করি যে সেখানে “পরিচারকেরা” এবং “ভোজাধ্যক্ষ” ছিলেন, যারা কী পরিবেশন করতে হবে বা কী করতে হবে তা নির্দেশ দিচ্ছিলেন। এই সমস্ত কিছু ইঙ্গিত করে যে সেই অনুষ্ঠানটি সুসংগঠিত ছিল এবং যথার্থভাবে তত্ত্বাবধান করা হয়েছিল। বিবরণটি শেষ হয় এই উক্তিটির দ্বারা যে সেই ভোজে তিনি যা কিছু করলেন এর দ্বারা, যীশু “নিজ মহিমা প্রকাশ করিলেন।” যদি তা একটি উচ্ছৃঙ্খল এবং অনিয়ন্ত্রিত সমাবেশ হত তবে কি তিনি সেই উপলক্ষে যোগ দেওয়া মনোনীত করতেন? নিঃসন্দেহে না।
১৮. যে কোন সামাজিক ঘটনা সম্বন্ধে কোন্ বিষয়গুলি অবশ্যই গভীরভাবে বিবেচনা করতে হবে?
১৮ তাহলে সেই বিশেষ উপলক্ষগুলি যেগুলির আয়োজক হয়ত আমরা সেগুলির সম্বন্ধে কী বলা যায়? আমরা এই কথাটি মনে রাখতে চাই যে অন্যদের সাদরে গ্রহণ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে যেন আমরা প্রত্যেকে “সত্যের সহকারী হইতে পারি।” তাই, একটি অনুষ্ঠানকে কেবলমাত্র “সাক্ষী” সমাবেশ এই ছাপ লাগানোই যথেষ্ট নয়। প্রশ্ন উঠতে পারে, বাস্তবে কি এটি সাক্ষ্য দেয় যে আমরা কে এবং আমরা কী বিশ্বাস করি? আমাদের কখনও এইধরনের উপলক্ষগুলিকে এই দৃষ্টিতে দেখা উচিত নয় যে এটিই হচ্ছে দেখার সুযোগ যে আমরা কত নিবিড়ভাবে জগতের কৌশলগুলিকে অনুকরণ করতে পারি, এইধরনের মনোভাবগুলিকে প্রশ্রয় দেওয়ার দ্বারা যা “মাংসের অভিলাষ, চক্ষুর অভিলাষ, ও জীবিকার দর্প।” (১ যোহন ২:১৫, ১৬) বরঞ্চ, এই উপলক্ষগুলি অবশ্যই যথার্থভাবে যিহোবার সাক্ষী হিসাবে আমাদের ভূমিকাকে প্রতিফলিত করবে এবং আমাদের নিশ্চিত হওয়া উচিত যে আমরা যা কিছু করি তা যেন যিহোবার গৌরব এবং সম্মান নিয়ে আসে।—মথি ৫:১৬; ১ করিন্থীয় ১০:৩১-৩৩.
‘বিনা বচসাতে অতিথি সেবা কর’
১৯. কেন আমাদের “বিনা বচসাতে পরস্পর অতিথি সেবা” প্রদর্শন করা প্রয়োজন?
১৯ যেহেতু জগতের অবস্থার ক্রমাগত অবনতি হচ্ছে এবং লোকেরা আরও অধিক মাত্রায় বিভক্ত হয়ে পড়ছে, তাই সত্য খ্রীষ্টানদের মধ্যে যে নিবিড় বন্ধন অস্তিত্বমান, তাকে শক্তিশালী করার জন্য আমরা যা কিছু করতে পারি আমাদের তা করা প্রয়োজন। (কলসীয় ৩:১৪) পিতর যেমন আমাদের উৎসাহিত করেন যে, এর জন্য আমাদের অবশ্যই “পরস্পর একাগ্র ভাবে প্রেম” প্রদর্শন করতে হবে। তারপর, ব্যবহারিক উক্তির দ্বারা তিনি যোগ করেন: “বিনা বচসাতে পরস্পর অতিথি সেবা কর।” (১ পিতর ৪:৭-৯) দয়া এবং সাহায্যকারী হওয়ার প্রচেষ্টা করে, আমরা কি আমাদের ভাইয়েদের প্রতি অতিথি-সেবা প্রদর্শন করার জন্য প্রথমে উদ্যোগ নেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করি? অথবা যখন এইধরনের সুযোগ আসে তখন আমরা কি বচসা করি? যদি করি, তাহলে আমরা যে আনন্দ লাভ করতে পারতাম তা বাতিল করে দিই এবং সাথে সাথে আমরা সৎকার্য করার জন্য সুখী হওয়ার যে পুরস্কার তা হারাই।—হিতোপদেশ ৩:২৭; প্রেরিত ২০:৩৫.
২০. বর্তমানের এই বিভক্ত জগতে যদি আমরা অতিথি-সেবা প্রদর্শন করি, তাহলে কোন্ আশীর্বাদ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে?
২০ আমাদের সহখ্রীষ্টানদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা, একে অপরের প্রতি অতিথিপরায়ণ হওয়া, অপরিমেয় আশীর্বাদ সকল নিয়ে আসবে। (মথি ১০:৪০-৪২) এইধরনের ব্যক্তিদের সম্পর্কে যিহোবা প্রতিজ্ঞা করেছেন যে তিনি “ইহাদের উপরে আপন তাম্বু বিস্তার করিবেন। ‘ইহারা আর কখনও ক্ষুধিত হইবে না, আর কখনও তৃষ্ণার্ত্তও হইবে না।’” যিহোবার তাম্বুতে থাকার অর্থ হল তাঁর সুরক্ষা এবং অতিথি-সেবা উপভোগ করা। (প্রকাশিত বাক্য ৭:১৫, ১৬; যিশাইয় ২৫:৬) হ্যাঁ, অনন্তকালের জন্য যিহোবার অতিথি-সেবা উপভোগের প্রত্যাশা নিকটেই।—গীতসংহিতা ২৭:৪; ৬১:৩, ৪.
আপনি কি ব্যাখ্যা করতে পারেন?
◻ যদি আমরা প্রকৃত আনন্দ এবং পরিতৃপ্তি খুঁজে পেতে চাই, তাহলে আমাদের অবশ্যই কোন্ বিষয়টি উপেক্ষা করা উচিত নয়?
◻ “পিতৃমাতৃহীন ও বিধবা” কারা এবং আমাদের কিভাবে তাদের “তত্ত্বাবধান” করা উচিত?
◻ আমাদের মাঝে “প্রবাসী” এবং ‘বিদেশীদের’ আমাদের কিভাবে দেখা উচিত?
◻ বর্তমানে কারা বিশেষ বিবেচনার যোগ্য?
◻ বিশেষ উপলক্ষগুলির মাধ্যমে কিভাবে অতিথি-সেবার সত্য মনোভাবকে প্রতিফলিত করা উচিত?
[১৬, ১৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
উৎসবমূলক উপলক্ষগুলিতে বিদেশীদের প্রতি, পিতৃহীন সন্তানদের প্রতি, পূর্ণ-সময় পরিচর্যাকারীদের প্রতি এবং অন্যান্য অতিথিদের প্রতি আমরা অতিথিপরায়ণ হতে পারি